২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৮:৫১

দুটি গণবিরোধী বিলের দুই প্রতিক্রিয়া

-বদরুদ্দীন উমর

১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে জাতীয় সংসদে দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস হয়েছে। একটি হল ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল, অন্যটি সড়ক পরিবহন বিল। লক্ষ করার বিষয় যে, প্রথম বিলটি নিয়ে অনেক বিক্ষোভ, বিরুদ্ধ সমালোচনা, হৈচৈ হলেও দ্বিতীয় বিলটি নিয়ে কোনো হৈচৈ তো দূরের কথা, সামান্য কথাবার্তাও শোনা যায় না।

আরও একটু ভালোভাবে লক্ষ করলে বোঝা যাবে যে, এ দুই বিলের প্রতিক্রিয়ার একটার স্পষ্ট শ্রেণী-চরিত্র আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল মূলত মধ্যশ্রেণীর বিবেচনার বিষয়, সড়ক পরিবহন বিলটি হল শ্রমিক স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত।

প্রথমে আমরা সড়ক পরিবহন বিলটি নিয়ে আলোচনা করব। দুর্ঘটনা সম্পর্কিত অপরাধের বিষয়ে বিলটিতে বলা হয়েছে, ‘এ আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, মোটরযান চালনাজনিত দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত হলে বা তার প্রাণহানি হলে তৎসংক্রান্ত অপরাধগুলো পেনাল কোড ১৮৬০ (অ্যাক্ট নং এক্সএলভি অব ১৮৬০)-এর এতদসংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে’ (যুগান্তর, ২০.০৯.২০১৮)।

শাস্তির বিষয়ে বিলটিতে বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে, ফৌজদারি কার্যবিধিতে যাই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তি বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত মোটরযান চালানোর কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত হলে বা তার প্রাণহানি হলে ওই ব্যক্তি অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন’ (যুগান্তর, ২০.০৯.২০১৮)।

বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত করলে ৩ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ট্রাফিক আইন অমান্য করলে পয়েন্ট কাটার ব্যবস্থাও থাকবে আইনে। নির্ধারিত পয়েন্টের নিচে গেলে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। চালককে নতুন করে আবার লাইসেন্স নিতে হবে (যুগান্তর, ২০.০৯.২০১৮)।

দেখা যাচ্ছে, এই বিলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে চালকদের বিরুদ্ধে বেশ কঠিন শাস্তিরই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটা ঠিক যে, দুর্ঘটনা ঘটলে তার জন্য চালক যদি দায়ী থাকে তাহলে তার শাস্তি অবশ্যই দরকার। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, দুর্ঘটনার জন্য চালক সব সময়েই দায়ী অথবা চালকই একমাত্র দায়ী। এ কথা কে না জানে যে, বাংলাদেশে যারা নানা ধরনের মোটরযান চালায় তাদের অধিকাংশেরই কোনো দক্ষতা নেই, কোনো প্রশিক্ষণ নেই, কোনো উপযুক্ত লাইসেন্স নেই। ভুয়া লাইসেন্সধারীর সংখ্যা অজস্র, যারা ঘুষ দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের থেকে লাইসেন্স নিয়ে থাকে।

চালকদের মধ্যে দায়িত্বহীন লোকের সংখ্যা কম নয়। অনেকেই বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে থাকে। কাজেই দুর্ঘটনার জন্য এ ধরনের চালকদের শাস্তি অবশ্যই দরকার। কিন্তু যেভাবে ও মাত্রায় চালকদের জন্য এক্ষেত্রে শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ১৮৬০ সালে প্রণীত ব্রিটিশ সরকারের আইনের আশ্রয় নিয়েই এ কাজ করা হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে এখনও পর্যন্ত সাধারণভাবে আইনের ভিত্তি ও কাঠামো ব্রিটিশ আইনের মতোই আছে। লর্ড মেকলের প্রণীত ঔপনিবেশিক আইনের শাসনই এখনও বাংলাদেশে চলছে।

দুর্ঘটনার জন্য চালক সরাসরি দায়ী হলেও এর আসল দায়িত্ব হল মালিকদের। প্রথমত, তারাই অদক্ষ শ্রমিকদের জেনেশুনে নিয়োগ দেয় অল্প মজুরিতে। চালকের প্রকৃত কোনো দক্ষতা আছে কিনা এটা যাচাই করে তারা দেখে না। যে সরকারি কর্মচারীরা লাইসেন্স দেয়ার মালিক তারাও দেখে না যাকে লাইসেন্স দিচ্ছে তার গাড়ি চালানোর কোনো যোগ্যতা আছে কিনা।

ঘুষ খেয়ে তারা লাইসেন্স দেয়। কাজেই দুর্ঘটনার জন্য এই সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব কম নয়। এছাড়া গাড়ির মালিকরা গাড়ির যত্ন ঠিকমতো করে না, গাড়ি চলার মতো অবস্থায় আছে কিনা (Roadworthy) সেটা দেখার কোনো প্রয়োজন বোধ করে না। গাড়ির মেরামত ঠিকমতো হয় না, কাজেই প্রায় ক্ষেত্রে গাড়ির অবস্থা খারাপের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। মালিকরা এসবই করে তাদের মুনাফা সর্বোচ্চ রাখার স্বার্থে। তাদের এই স্বার্থই সড়কপথে মানুষের জীবনহানি ঘটায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিলটিতে দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত বিষয়ে মালিকদের কোনো কথাই নেই! তাদের দায়িত্বের কোনো উল্লেখই নেই!!

দুর্ঘটনার জন্য তাদেরও যে শাস্তি হওয়া দরকার তার কোনো নাম-নিশানা নেই। তাদের সম্পূর্ণ ছাড় দিয়ে শুধু চালকদের দোষী সাব্যস্ত করে আইনটি তৈরি করা হয়েছে। এদিক থেকে এ আইনের স্বার্থ, শ্রেণী-চরিত্র, শ্রমিক শ্রেণীবিরুদ্ধ চরিত্র এবং মালিকপক্ষের খেদমতগারী খুব স্পষ্টভাবেই লক্ষ করার বিষয়। এখানে আরও একটা বিষয় আছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেক্ষেত্রে নিহত ও আহতদেরকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কোনো কথাই এই বিলে নেই।

যে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও তার মন্ত্রী এই আইনের খসড়া তৈরি করেছেন, তারা যে স্বার্থ, শ্রেণী অবস্থান থেকেই এ কাজ করেছেন এবং দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মালিকদেরকে জেনেশুনে ছাড় দেয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। এদিক দিয়ে এই আইন হল চরম প্রতিক্রিয়াশীল এবং জনস্বার্থবিরোধী। এখানে আরও উল্লেখ করা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভের মুখে এই আইনটি পাস হলেও সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধের, এমনকি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রেও এ আইন কোনো ভূমিকা রাখবে না এবং রাখছেও না। আইন পাস হোক আর না-ই হোক, এখনও পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার হার কমেনি। উপরন্তু সংবাদপত্র রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, এই হার বৃদ্ধি পেয়েছে!

এখানে লক্ষ করার বিষয়, যে শিক্ষার্থীরা সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল এবং যারা তাদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল, তারা কেউই সরকারের এই সড়ক পরিবহন বিলের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেনি! আন্দোলন করেনি!! একটি বাক্য পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি!! এর থেকে বোঝা যায়, হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে জনশত্রুদের বিরুদ্ধে জনগণের বিভিন্ন অংশ মাঝে মাঝে আন্দোলনে নামলেও জনগণের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার মান এখনও পর্যন্ত বেশ নিু পর্যায়েই রয়ে গেছে।

১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল পাস হয়েছে। এটিকে নিঃসন্দেহে একটি কালা-কানুন হিসেবে অভিহিত করা যায়। এতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের আওতাভুক্ত অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন’ (যুগান্তর, ২০.০৯.২০১৮)।

এছাড়াও ৩২(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা-১ এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন’ (যুগান্তর, ২০.০৯.২০১৮)। আইনটিতে ঔপনিবেশিক আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অন্তর্ভুক্ত করে এর পরিধি আরও বাড়ানো হয়েছে।

বলাই বাহুল্য, এটি একটি প্রতিক্রিয়াশীল ও ফ্যাসিস্ট আইন। এই বিলের মাধ্যমে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রদ ও কণ্ঠরোধ করার ব্যবস্থা হয়েছে। এই বিল পরোক্ষভাবে শ্রমিক স্বার্থের বিরোধী হলেও বর্তমানে এর দ্বারা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর স্বার্থে আঘাত পড়বে সব থেকে বেশি। এ কারণে মধ্যশ্রেণীর এমন কোনো অংশ নেই যারা এই বিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়নি। সাংবাদিক ইউনিয়ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক পার্টি, পেশাগত সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং এই মুহূর্তে সরব আছে।

এমনকি ১০টি পশ্চিম দেশ এবং ইউরোপিয়ান কূটনৈতিক ব্যক্তিরা আইনের ২১, ২৮, ৩২ ও ২৪ ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এসব প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, উদ্বেগ প্রকাশ ইত্যাদির মাধ্যমে যথার্থভাবেই এই ফ্যাসিস্ট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকারের শ্রেণী-চরিত্র খুব স্পষ্টভাবেই উদ্ঘাটিত হচ্ছে। কিন্তু এটা অস্বীকার করার কিছু নেই যে, মধ্যশ্রেণীর স্বার্থে আঘাত লাগার কারণেই এই বিলের বিরুদ্ধে এ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

অন্যদিকে, উপরে উল্লিখিত সড়ক পরিবহন বিল সম্পর্কে নীরবতা থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, গণতন্ত্র ‘পুনরুদ্ধারের’ জন্য এখন যেভাবে শোরগোল উঠেছে, গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন অনস্বীকার্য হলেও এরও একটি নিদিষ্ট শ্রেণী-চরিত্র আছে। এই গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে শ্রমিক স্বার্থ, শ্রমজীবী গরিব জনগণের স্বার্থ অনেকখানিই বিযুক্ত।

২৪.০৯.২০১৮

বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/93874