২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, সোমবার, ৭:০৭

ভাঙনের এক যুগ

জমি-বাড়ি হারিয়েছে ৪৩ জেলার আড়াই কোটি মানুষ

দেশের ৪০৫ নদ-নদীর মধ্যে ৩০০টি প্রতিনিয়ত ভাঙ্গছে। এসব নদীর মধ্যে ১৫৪টি পয়েন্টে প্রতিদিন ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। কেউ হচ্ছেন সাধারণ, আবার কেউ ভয়াবহ ভাঙ্গনের শিকার। এর মধ্যে ২ হাজার কিলোমিটার শহর রক্ষা বাঁধ এবং ২৫ হাজার হেষ্টর জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গত দুই সপ্তাহে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা, কীর্তিনাশা, মরাপদ্মা, গড়াই, বুড়িগঙ্গা, ইছামতি নদীতে ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এসব নদী তীর এলাকায় প্রায় ৪০ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে বসতবাড়ি ও জমি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে বলে বিভিন্ন জেল প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।

গত এক যুগে দেশের ৪৩টি জেলার বিভিন্ন নদীর একাধিকবার ভাঙ্গনে জমি ও বাড়ি হারিয়েছে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। আবার তিন দফা নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়েছেন দেড় কোটি মানুষ। বর্তমান সরকারে আমলে ৭ বছরে নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে ৩৫ লাখ পরিবারের ঘর বাড়ি। কিন্তু নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে কিছু ক্ষতিপূরণ পেয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।
এদিকে ৪৩টি জেলার ১১৯টি উপজেলার ১২৮টি বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিস্কাশন, সেচ ও শহর সংরক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে বলে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ১০ বছরের অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নীলফামারী, লালমনিরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, জামালপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, শরিয়তপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, মাদারীপুর, ভোলা, ফেনী, চাঁদপুর ও কুমিল্লা জেলায় নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ।
গঙ্গা,পদ্মা, ব্রক্ষনপুত্র-যমুনা, এবং মেঘনা নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও নদী ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। নদী ভাঙ্গন, নদী ভরাট, লবনাক্ততা এবং জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানে নদীর নাব্যতা ও ধারণ ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে দেশের ২৪টি নদ-নদীর ড্রেজিং সমীক্ষা করেছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মাহাফুজুর রহমান।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার ইনকিলাবকে বলেন, নড়িয়া উপজেলায় পদ্মার ভাঙন কবলিত এলাকায় নদীতে তিনটি ড্রেজার একযোগে খননের কাজ শুরু করবে। এতে পদ্মার স্রোতকে নদীর মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত করবে। এর ফলে পদ্মার ডান তীরের ভাঙ্গনের তীব্রতা অনেকটাই কমে আসবে। তিনি আরো বলেন, দেশে ৪০৫ নদ-নদীর মধ্যে ৩০০টির ১৫৪টি পয়েন্টে ভাঙ্গন রয়েছে। সেগুলো পরীক্ষা করা হবে। এর জন্য সকল জেলায় একটি করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা শুধু নদী ভাঙ্গনের তথ্য মন্ত্রণালয়কে জানাবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মাহাফুজুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, ভাঙ্গন রোধে নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে মূল সমস্যা হচ্ছে অর্থ। বরাদ্দ পাওয়া গেলে এসব প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, এবারে অনেক নদীতে ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। আবার অনেক নদীতে সাধারণ ভাঙ্গন রয়েছে। সব মিলে নদী তীরের লোকজন কেউ তিনবার আবার কেউ দুইবার নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু তাদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, নদীর তীরবর্তী এলাকার মধ্যে ১৫৪টি পয়েন্টে প্রতিদিন ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ১০২টি, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ১১৫টি, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৮৭টি, উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ৬১টি, পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলে ১৬টি এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ২৪টি নদী রয়েছে। এসব নদীর মধ্যে ৩০০টি নদী প্রায় কোনো না কোনোভাবে প্রতিদিন ভাঙ্গছে। যমুনা নদীর তীরেই ভেঙেছে দুই হাজার ২২১ হেক্টর জমি। তিন হাজার ৫৯৩ কিলোমিটার বাঁধ। ছয় হাজার ৮৪৩ কিলোমিটার সড়ক। আর এবার যমুনায় ভাঙনের শিকার হচ্ছে দুই হাজার ১৭৩ হেক্টর জমি, আট হাজার ৮১৯ কিলোমিটার বাঁধ ও পাঁচ হাজার ৩১০ কিলোমিটার সড়ক।
এ ছাড়া ৩৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছয়টি হাটবাজার, দুটি সরকারি অফিস, তিনটি বেসরকারি অফিস, তিনটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ২৭টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়েছে। যমুনার গর্ভে বিলীন হয়েছে ৯০ হাজার ৩৬৭ হেক্টর জমি। সিরাজগঞ্জে বিলীন হয়েছে ২২ হাজার ৭৮৪ হেক্টর জমি। কুড়িগ্রামে ১৮ হাজার ৪৭৯ হেক্টর, গাইবান্ধায় ৯ হাজার ৩৪৮ হেক্টর, জামালপুরে ১০ হাজার ৬০৮ হেক্টর, বগুড়ায় ১০ হাজার ৯৩৮ হেক্টর, টাঙ্গাইলে ৯ হাজার ১৫০ হেক্টর এবং মানিকগঞ্জে ছয় হাজার ৩৩৫ হেক্টর জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে।

পদ্মা অববাহিকার বিভিন্ন জেলায় শাখা নদ-নদীগুলোর তীরেই ভেঙেছে ৫৮৩ হেক্টর জমি ও ১৫৯ কিলোমিটার সড়ক। এবার ভাঙনের কবলে পড়েছে ৫৫২ হেক্টর জমি ও ৩৭২ কিলোমিটার সড়ক। পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়েছে ২৯ হাজার ৮৪১ হেক্টর এলাকা। ২৫ হাজার ৯ হেক্টর এলাকা। পদ্মা নদীর গর্ভে বিলীন হয়েছে কুষ্টিয়ার ১১ হাজার ৮৫৭ হেক্টর জমি। চাঁপাইনবাবগঞ্জে চার হাজার ৬৯৩ হেক্টর, রাজশাহীতে এক হাজার ৬৭০ হেক্টর, নাটোরে দুই হাজার ৪৫ হেক্টর, পাবনায় দুই হাজার ২০৩ হেক্টর এবং রাজবাড়ীর কাছে ভাঙনের শিকার হয়েছে সাত হাজার ৩৭৩ হেক্টর জমি।
কুড়িগ্রামের প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোছা. সুলতানা পারভীন ইনকিলাবকে বলেন, জেলার চারদিকে ধরলা, দুধকুমার, তিস্তা, ব্রক্ষনপূত্র নদী রয়েছে। প্রতিদিন নদীগুলো ভাঙ্গছে। পশ্চিমে উলিপুরের থেতরাই, দলদলীয়, নাজিমখা, রাজারহাট, চিলমারীসহ সব উপজেলায় নদী ভাঙ্গছে। এসব এলায় ভাঙ্গন রোধে প্রকল্পের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দিয়েছি।
মানিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস এম ফেরদৌস ইনকিলাবকে বলেন, মানিকগঞ্জ জেলায় গতকাল পযন্ত ১০ থেকে ১৫ হেক্টর জমি নদীতে ভেঙ্গে গেছে। এবার ৮টি নদী ভাঙ্গন রোধে প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৩০৬টি পরিবারকে বসবাসের জন্য ব্যস্থা করা হয়েছে। পরে তাদের সরকারি জমি বরাদ্দ দেয়া হবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/155242