বিশাল বিপুল জলরাশির নদী যমুনার শাখা ধলেশ্বরী এখন ভরপুর। কিন্তু কদিন বাদেই আসবে শুকনা মৌসুম। তখন ধলেশ্বরীর বুকে ‘কূপ’ খুঁড়ে পানি তোলার প্রাণপণ চেষ্টার এ দৃশ্য আবার দেখা যাবে মানিকগঞ্জ সদরে। — ফাইল ছবি
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১০:২৭

ভরাট আর দখল-দূষণে বিপন্ন ধলেশ্বরী

মানিকগঞ্জ জেলা শহর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে জাগীরে ধলেশ্বরী নদীর ওপর রয়েছে ৬০০ ফুট দীর্ঘ একটি সেতু। ১৯৬৪ সালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক নির্মাণের সময় সেতুটি স্থাপন করা হয়। বর্তমানে এই সেতুর নিচ দিয়ে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত ধলেশ্বরীর দিকে তাকিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করে, এই সরু খালের ওপর এত বড় সেতুর কী দরকার ছিল? অথচ তারা জানে না এই নদী দিয়ে একসময় স্টিমার চলত। চলত বড় বড় মালবাহী জাহাজ।

পদ্মা ও যমুনা ছাড়া মানিকগঞ্জ জেলার অন্যতম নদী ধলেশ্বরী। মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন সম্পাদিত মানিকগঞ্জের ইতিহাস বই সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলায় যমুনা নদী থেকে একটি শাখা ধলেশ্বরী নাম ধারণ করে মানিকগঞ্জ জেলায় প্রবেশ করে। এরপর মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া, মানিকগঞ্জ সদর, সিঙ্গাইর উপজেলা হয়ে ঢাকার ধামরাইয়ের কাছে বংশী নদীতে মিশেছে। পরবর্তী সময়ে সাভার হয়ে একটি শাখা ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে মিশেছে। অন্য একটি শাখা মুন্সীগঞ্জের দক্ষিণ-পূর্বে মেঘনায় মিশেছে। সাটুরিয়া উপজেলার তিল্লির কাছে ধলেশ্বরী নদীর একটি শাখা কালিগঙ্গা নাম ধারণ করে ঘিওর উপজেলার দিকে প্রবাহিত হয়েছে। বর্তমানে এই শাখা দিয়ে পানিপ্রবাহ অপেক্ষাকৃত বেশি। উৎসমুখ টাঙ্গাইল থেকে মুন্সীগঞ্জের মেঘনা নদীতে পতিত হওয়া পর্যন্ত ধলেশ্বরী নদীর দৈর্ঘ্য ১৬৮ কিলোমিটার। আর মানিকগঞ্জ অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার।
কিন্তু দখল, দূষণ আর পলিমাটিতে ভরাট হওয়ায় নদীটি বর্তমানে মৃতপ্রায়। মানিকগঞ্জের বেশির ভাগ এলাকায় এই নদী বছরের বেশির ভাগ সময় ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হয়। কোনো কোনো অংশ একেবারেই শুকিয়ে যায়। ‘ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের জরিপে দেখা গেছে, তিল্লির কাছে চর জেগে ওঠার কারণে মূলত ধলেশ্বরী নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। ‘তিল্লি মুখ’ খনন করে বালুচর অপসারণ না করলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নদীটি স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে তারা অভিমত দিয়েছে। ধলেশ্বরী নদী বাঁচাতে ‘তিল্লি মুখ’ খনন তাদের প্রধান দাবি।

সরেজমিন দেখা গেছে ‘তিল্লি মুখ’ থেকে জাগীর সেতু পর্যন্ত নদীর বুকে ফসলের ক্ষেত। বলে না দিলে বোঝাই যাবে না কিছুদিন আগেও এখান দিয়ে প্রবাহিত হতো বিশাল একটি নদী। তিল্লি গ্রামের আবদুল বারেক জানান, ১৯৯৮ সালের আগেও ‘তিল্লি মুখ’ প্রশস্ত ও গভীর ছিল। কিন্তু ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালের দুই দফা ভয়াবহ বন্যায় চর পড়ে ‘তিল্লি মুখ’ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে শুধু বর্ষা মৌসুমে ক্ষীণ ধারায় পানি প্রবাহিত হয়। ফলে তিল্লি থেকে সিঙ্গাইর পর্যন্ত ধলেশ্বরী নদীতে বেশির ভাগ সময় পানির প্রবাহ থাকে না। তিনি জানান, বছরের এক-দুই মাস ছাড়া অন্য সময় নদীর বুকে বিভিন্ন ধরনের ফসলের চাষাবাদ হয়।

জাগীর গ্রামের আবদুল হক জানান, নদীতে পানি প্রায় থাকেই না। যাও থাকে কারখানার বর্জ্যে দূষিত হওয়ায় তাও ব্যবহার করা যায় না। তিনি জানান, জাগীর শিল্পাঞ্চলের বেশির ভাগ কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরীতে। এ নিয়ে গ্রামবাসী অনেকবার মানববন্ধন করেছে। কিন্তু কাজ হয়নি।
ধলেশ্বরী নদীর সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা সিঙ্গাইরের ধল্লা এলাকায়। এখানে বংশী নদীর সঙ্গে মেশার কারণে প্রবাহ মোটামুটি ভালো থাকলেও দখল ও দূষণে বিপর্যস্ত। সাভারের শত শত কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরীতে। ঢাকা থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের পর অবস্থা আরো ভয়াবহ হয়েছে। এলাকাবাসী জানায়, ধলেশ্বরী নদীতে এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। পানিতে দুর্গন্ধ। কোনো কাজেই পানি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না।

দূষণের পাশাপাশি ধলেশ্বরী নদীর জমি দখল চলছে বছরের পর বছর। নদী ভরাট করে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে অর্ধশত কারখানাসহ বিভিন্ন পাকা অবকাঠামো ও ইটভাটা। আবাসন প্রকল্পের নামেও দখল হচ্ছে নদীর জমি। সর্বশেষ নদীর প্রায় ১৩ একর জমি দখল করে নর্দান পাওয়ার প্লান্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিঙ্গাইরের ধল্লা মৌজার ধলেশ্বরী নদীতে চর জেগে উঠলে ১৯৮৬-৮৭ সালে চাষাবাদের জন্য কিছু জমি ভূমিহীনদের ১৫ বছর মেয়াদি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে প্রভাবশালীরা জোর করে নামমাত্র টাকায় ভূমিহীনদের কাছ থেকে নিজেদের নামে জমি হস্তান্তর করে নেয়। অনেকের জমি জোর করে দখলও করে নেয় প্রভাবশালীরা। এই প্রভাবশালীরাই পরে ওই জমি ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে। এ অবস্থায় ২০১২ সালে সিঙ্গাইর উপজেলা কৃষি খাস জমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত কমিটির এক সভায় বন্দোবস্ত দেওয়া ২৯৭টি কেস বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এসংক্রান্ত চিঠিতে মানিকগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ মন্তব্য করেন, সংশ্লিষ্ট সব জমি বছরের বেশির ভাগ সময় ধলেশ্বরী নদীর পানিতে নিমজ্জিত থাকে। এখানে স্থাপনা গড়ে তুললে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে, যা পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। নদী ও পরিবেশ রক্ষায় তিনি ওই ২৯৭টি বন্দোবস্ত কেস বাতিলের ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন। এরপর থেকে ধল্লা মৌজার বন্দোবস্ত দেওয়া খাস জমি হস্তান্তর, নামজারি, খাজনা গ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ভূমি প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় প্রভাবশালীদের খাস জমি দখল ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত থাকে।

চলতি বছরের ২৬ জুন ধলেশ্বরী নদীর অবৈধ দখল প্রতিরোধ ও দূষণ রোধে জেলা নদী রক্ষা কমিটি একটি সভা করে। জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার এবং সদস্য মো. আলাউদ্দিন। ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার ধলেশ্বরী নদীর অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি এবং সীমানা পিলার স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। তিনি এও বলেন, নদীর কোনো জমি রেজিস্ট্রির আগে নদী ছিল কি না নিশ্চিত হয়ে রেজিস্ট্রি করতে হবে।

ওই সভায় ধলেশ্বরী নদীর তিল্লি মুখের কাছে এক কিলোমিটার খনন, অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি, সীমানা পিলার স্থাপন, ধলেশ্বরী নদীর ফোরসোর এলাকা সংরক্ষণ, রেজিস্ট্রির আগে জমি নদীতে ছিল কি না তা নিশ্চিত হওয়া এবং নর্দান পাওয়ার প্লান্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজাহারুল ইসলাম আরজু বলেন, ‘সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে আমরা কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখছি না। কাগজ-কলমে বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও ধলেশ্বরী নদী দখল-দূষণ অব্যাহত রয়েছে।’
সিঙ্গাইর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহম্মদ জুবায়ের দাবি করেন, অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত হয়েছে। তাদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলছে। পাওয়ার প্লান্টে দখল করা জমির বেশ কিছু এরই মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অংশও উদ্ধার করার আইনগত প্রক্রিয়া চলছে।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/09/23/683168