২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১০:০৮

ভাড়া আদায়ে কোন নিয়মই মানছে না রাজধানীর গণপরিবহণ

রাজধানীতে গণপরিবহণে ভাড়া নৈরাজ্য চরমে উঠেছে। বাস ভর্তি করে দাঁড়ানো যাত্রী নিয়েও সিটিং সার্ভিসের নামে আদায় করা হচ্ছে দু-তিন গুণ বেশি ভাড়া। গাড়িতে উঠে কাছাকাছি কোনো স্টপেজে নামলেও যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে বাস মালিকের স্বনির্ধারিত দূরবর্তী স্টপেজের ভাড়া। সিটিং বলে হেঁকে যাত্রী নেয়া হচ্ছে দাঁড় করিয়ে। কিন্তু ভাড়া সিটিংয়ের। এ নিয়ে প্রতিদিনই যাত্রীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হচ্ছে কন্ডাক্টর ও চালকদের।

সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১ নবেম্বর ঢাকা ও আশপাশের পাঁচ জেলা এবং চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। কিছুদিন পর তেলের দামও কমে। কিন্তু নানা কায়দায় বাড়ানো হয় ভাড়া। সরকার নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে গাবতলী (১০ কিলোমিটার দূরত্ব) ছোট বাসের ভাড়া হওয়ার কথা ১৫ টাকা। কিন্তু আদায় করা হচ্ছে ২৫ টাকা। মগবাজার থেকে থেকে খিলক্ষেতের দূরত্ব সাড়ে ১০ কিলোমিটার। প্রথম দিকে ভাড়া নেয়া হতো ১২ থেকে ১৫ টাকা। বছর খানেক ধরে ভাড়া নিচ্ছে ২০ থেকে ৪০ টাকা।
রাজধানীতে বড় বাসে সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা, ছোট বাসে ৫ টাকা। কিন্তু এই বিধান মানা হচ্ছে না কোনো বাসে। কোনো কোনো পরিবহণে সর্বনিম্ন ভাড়া ২৫ থেকে ৪০ টাকা। বাসের চালক-কন্ট্রাক্টররা বলছেন, মালিকের নির্ধারণ করা ভাড়া নেন তারা। ওয়ে বিলের হিসাবে মালিককে টাকা দিতে হয় তাদের। আর দাঁড়ানো যাত্রীরা জোর করে বাসে ওঠেন। মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বাসে নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন বরাদ্দ রাখার যে বিধান বেশ কয়েক বছর ধরে মানা হচ্ছিল, সেটিও বাস মালিকরা বন্ধ করে দিয়েছে সিটিং সার্ভিসের নামে। ফলে সিটিং সার্ভিস সেবা না দিয়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়ার কারণে মহিলা ও প্রতিবন্ধীরা পড়ছে ভোগান্তিতে। সিটিংয়ের ডাক শুনে বাসে উঠে দেখেন আসন নেই। উপরন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে দাঁড়ানো যাত্রীতে বাস ভরে যায়। ফলে নারী বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী মেয়েরা হয়রাণির শিকার হয় বেশি।
উল্লেখ্য, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ নানা অভিযোগে গত বছর এপ্রিলে রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। পরে এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করার পর থেকে নানা কৌশলে দাঁড়িয়ে যাত্রী বহন শুরু করে বাসগুলো। কিন্তু ভাড়া আদায় করা হয় সিটিং সার্ভিসের।
সরেজমিন দেখা গেছে, গুলিস্তান থেকে নবীনগর চলাচল করে ওয়েলকাম পরিবহন। শুরুতে গুলিস্তান থেকে খামারবাড়ি পর্যন্ত ১০ টাকা ভাড়ার বিধান করলেও বর্তমানে সেটা বন্ধ করে দিয়েছে পরিবহণটি। এখন কোনো যাত্রী গুলিস্তান থেকে উঠে যেখানেই নামুক তাকে গাবতলী পর্যন্ত ২৫ টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে।

রফিকুল ইসলাম প্রতিদিন সাভার থেকে ঢাকায় এসে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সিটিং বাসে সিটিও নাই। দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া হয়। কিন্তু ভাড়া ঠিকই নেওয়া হয় সিটিংয়ের। এ নিয়ে প্রায়ই যাত্রীদের সঙ্গে কন্ডাক্টরের বাকবিত-া হয়। লিয়াকত নামের আরেক যাত্রী বলেন, খিলক্ষেত থেকে মগবাজার পর্যন্ত বলাকা বাস নেয় ২০ টাকা। একই দূরত্বে শতাব্দী নেয় ৪০ টাকা, প্রভাতী-বনশ্রী ও গাজীপুর পরিবহন নেয় ৩০ টাকা। একেক একেক পরিবহণ তাদের ইচ্ছামতো ভাড়ার পরিমাণ নির্ধারণ করে নিয়েছে। যাত্রা শুরুর জায়গা থেকে শেষ স্টপেজ পর্যন্ত একটি বাস ৫-৭ বার সিট বিক্রি করে। আর এর মধ্য দিয়ে প্রতিটি সিট থেকে আয় করছে কয়েক গুণ ভাড়া।
জাহাঙ্গির আলম যাত্রাবাড়ির শনির আখড়ায় থাকেন। তার অফিস বাংলামটরে। তিনি বলেন, নামে সিটিং হলেও প্রতিটি বাস ভরে যাত্রী তোলা হয়। বাসের পেছন বা মাঝখান থেকে নামতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয় যাত্রীদের। বিশেষ করে মহিলাদের কষ্টের সীমা থাকে না। অথচ তারা ভাড়া মিটিয়েছেন সিটিংয়ের। সদরঘাটের বোরহান উদ্দীন বলেন, সদরঘাট-চিড়িয়াখানা রুটের তানজিল পরিবহণে সদরঘাট থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাব পর্যন্ত ভাড়া ৫ টাকা। কিন্তু গত বুধবার থেকে কন্ডাক্টররা যাত্রীদের বলছে যারা পল্টন নামবেন তাদের ১০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে লাব্বাইক পরিবহনের কন্ডাক্টর কালাম বলেন, আমাদের সিটিং সার্ভিস। কতজন যাত্রী আছে সেটা চেকিং করে ওয়েবিলে লিখে দেয়া হয়। সেই অনুযায়ী মালিককে আমাদের টাকা দিতে হয়। দাঁড়ানো যাত্রী বহন করার বিষয়ে তিনি বলেন, গাড়ির সংখ্যা কম। যাত্রীরাই জোর করে গাড়িতে ওঠে। আবার অনেক সময় যাত্রীরা নেমে গেলে দাঁড়ানো যাত্রীরা বসে পড়ে।

এদিকে রাজধানী জুড়ে গণপরিবহণে ভাড়া নৈরাজ্য চললেও এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সড়ক পরিবহণ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ মাঝে মধ্যে লাইসেন্স, ফিটনেস পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন সময় অভিযান চালায়। কিন্তু বাড়তি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে সংস্থাটির পক্ষ থেকে অভিযানের কথা যায়নি।
রাস্তায় দায়িত্বরত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, আমাদের দেশে সবার মধ্যেই নিয়ম ভাঙ্গার প্রবণতা রয়েছে; তাই এদেশে পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরবে বলে মান হয় না। এজন্য আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
প্রসঙ্গত গত ২৯ জুলাই ঢাকার রাস্তায় গাড়িচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় সহপাঠিরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে। এই আন্দোলন পরবর্তীতে দেশের অন্যান্য স্থানেও ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভ ৮ আগস্ট পর্যন্ত গড়ায়।

http://www.dailysangram.com/post/346468