‘ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮’র ৩২ ধারাসহ বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা।
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:২৬

সবাই শঙ্কিত ৩২ ধারা নিয়ে

পুনর্মূল্যায়নের বিষয়ে আলোচনায় বসব : মমতাজ উদ্দিন আহমেদ * আমাদের মতামত প্রাধান্য দেয়া হয়নি : সুলতানা কামাল * বাকস্বাধীনতা সীমিত করতে এ আইন : ড. শাহদীন মালিক * সচেতন মানুষের রুখে দাঁড়ানো উচিত : ড. আসিফ নজরুল


সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষক ও বিভিন্ন পেশাজীবীসহ অংশীজনের মতামতকে উপেক্ষা করে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া বিল সম্পর্কে তারা বলেন, বাক-স্বাধীনতাকে সীমিত করার জন্য সরকার এ ধরনের আইন করেছে।
গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে এমনটি আশা করিনি। তারা বলেন, শুধু সাংবাদিক নয়, দেশের সব নাগরিকের কাছে এটি আতঙ্কের আইন।
সাংবাদিকরা কাজ করতে গিয়ে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হবেন। ৫৭ ধারার চেয়েও চরমভাবে হয়রানি হবেন সংশ্লিষ্টরা। এই আইনের বিরুদ্ধে অধিকার সচেতন মানুষের রুখে দাঁড়ানো উচিত। আইনটির পুনর্মূল্যায়ন করা যায় কিনা সে দাবিও করেছেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।
বুধবার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিলটি উত্থাপন করলে কণ্ঠভোটে তা পাস হয়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া অধিবেশনে বিলটি পাসের আগে জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা।

প্রস্তাবটি কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। বিল পাসের খবর পেয়ে বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদসহ গণমাধ্যম মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেছেন, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং গণতন্ত্রের জন্য এটি এক দুঃখের দিন।
এত সমালোচনা ও বিরোধিতা সত্ত্বেও কেন সরকার এমন একটা আইন করল দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন নাগরিকের কাছে ছিল এমনই প্রশ্ন। এর জবাবে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন এবং ৩২ ধারাসহ বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে তারা আতঙ্ক ও আশঙ্কার কথা বলেন।
বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ : বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি মনে করি এ ধরনের একটি আইনের প্রয়োজন ছিল। তবে আইনটি নিয়ে যেহেতু বিতর্ক আরম্ভ হয়েছে, আমরা এ নিয়ে বোর্ড সদস্যরা বসব।
কোনো সমস্যা দেখা দিলে কাউন্সিল তো বসে থাকতে পারে না। পুরো আইনটি নিয়ে বসে আলোচনা করে বিবৃতি দেব। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরও মতামত নেয়া হবে। আমি মনে করি, আইন তো রিফিল (পুনর্মূল্যায়ন) হয়।

এজন্য সবাইকে বসতে হবে। বসে আলোচনা করে দেখতে হবে এ ধরনের সুযোগ আছে কিনা। তিনি বলেন, ৫৭ ধারা নেই, তবে ওই ধারার অপরাধকে তিন ভাগে বিভক্ত করে এ আইনে আনা হয়েছে।
এ আইনের ৩২ ধারার ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইনের ৬ ও ৯ ধারা সাংবাদিকরা অনুসরণ করতে পারেন। কোনো দফতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলবেন, আমি তথ্য অধিকার আইনের আওতায় কাজ করছি।
সুলতানা কামাল : বিশিষ্ট মানবাধিকার নেত্রী ও টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল যুগান্তরকে বলেন, আমি মনে করি এটি একটি অনাকাক্সিক্ষত আইন। আইনটি নিয়ে আমরা বারবার মতামত দিয়েছি। অংশীজনের মতামত নিয়েছে সরকার।
সরকার বলেছে, আপনাদের মতামতকে গুরুত্বসহকারে দেখা হবে। ৫৭ ধারা দেখব। কিন্তু আমরা কি দেখছি? ৫৭ ধারা এ আইনের চারটি ধারার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া এতে অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট নিয়ে আসা হয়েছে।
আমরা স্তম্ভিত, মর্মাহত। সরকার কিভাবে আমাদের সঙ্গে আইনটি নিয়ে এমন আচরণ করল। এটা একটি কালো আইনের পর্যায়ে পড়ে। এ আইনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সব বিবেচনা রেখে দেয়া হয়েছে। এটি কালাকানুনের মধ্যেই পড়ে।

ড. শাহদীন মালিক : দেশের প্রখ্যাত আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ফৌজদারি আইনে শারীরিক আঘাত দেখা যায়। কিন্তু এ আইনে ক্ষতি মাপা যায় না। আইন অনুযায়ী ঘৃণা-বিদ্বেষের সংজ্ঞা কি হবে? দুনিয়ার কোনো ফৌজদারি আইনে যে ক্ষতিটা মাপা যায় না, সেটা এ আইনে করা হয়েছে। এটা কোনো আইনই হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাতের বিষয়ে যে ধারাটি রয়েছে সেখানে এমনও তো হতে পারে, আওয়ামী লীগের পক্ষে না লিখলে চেতনার পরিপন্থী হয়ে যাবে। কম্পিউটার চালাবেন এমন ব্যক্তিও এ আইনের অধীনে পড়ে যাবেন। বাস্তব জগতে যেটা নেই সেটা নিয়ে মামলা হবে।
অবশ্যই আইনটির অপপ্রয়োগ হবে। এত সমালোচনার পরও যেহেতু সরকার আইনটি করেছে, অপরিবর্তনীয় অবস্থায় পাস করেছে, তাহলে মনে হচ্ছে সরকার এ আইন সংশোধন করবে না। আমি মনে করি, বাক স্বাধীনতাকে সীমিত করার জন্য এ আইন করা হয়েছে।
আসিফ নজরুল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ৫৭ ধারার চেয়েও খারাপ। কারণ ৫৭ ধারাকে চারটি ভাগে বিভক্ত করে চারটি আলাদা সেকশনে রাখা হয়েছে।

ফলে ৫৭ ধারার কারণে যেভাবে সরকারের সমালোচনাকারী ও ভিন্নমত পোষণকারীরা হয়রানির সম্মুখীন হতেন, মিথ্যা মামলার সম্মুখীন হতেন, মামলার আতঙ্কের মুখে থাকতেন সেটা অবশ্যই অব্যাহত থাকবে।
নতুন আইনে স্বাধীন সাংবাদিকতা রুদ্ধ করার জন্য একটা ভয়ঙ্কর বিধান করা হয়েছে, সেটা হল ৩২ ধারা। এখন এ ধারাতে বলা হয়েছে, অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের অধীনে যে অপরাধগুলো আছে সেই অপরাধগুলো যদি ইলেকট্রকনিক যন্ত্রের মাধ্যমে সংগঠন করা হয় তাহলে ১৪ বছর কারাদণ্ড হবে।
অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের মাধ্যমে সংরক্ষিত এলাকা বলতে সরকারের যে কোনো অফিসকে বোঝানোর সুযোগ রয়েছে। সরকার যে কোনো এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করতে পারে। সরকার তার সব মন্ত্রণালয়কে অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের আওতায় সংরক্ষিত ঘোষণা করতে পারে।
যদি সরকার এ ধরনের ঘোষণা করে তবে ওইসব এলাকায় বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা অপরাধ হয়ে যাবে এবং সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান থাকবে।

সাংবাদিকরা যদি প্রতি স্তরে স্তরে অনুমতি নিয়ে একটা জায়গায় ঢোকেন, অনুমতি নিয়ে একটা নথি দেখতে চান বা প্রকাশ করতে চান তাহলে দুর্নীতিবাজ যারা আছেন মন্ত্রী বা আমলা বা সরকারি কর্মকর্তা, তারা কি নিজে সেধে সেধে বলবেন যে ভাই আসেন আমরা একটা দুর্নীতি করেছি, আমার সম্পর্কে একটা রিপোর্ট ছাপেন। ডকুমেন্ট দিলাম। এটা হয় নাকি কখনও।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা মানেই তো এটাতে এক ধরনের উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকে। কিন্তু এটার পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ করা হয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করলে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয়ার বিধান আছে। অথচ অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টে ৩ বছরের সাজার কথা বলা আছে। এখানে আছে ১৪ বছর। এটা অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের চেয়েও খারাপ। তিনি আরও বলেন, এ আইনে মানহানির দায়ে মামলা করার বিধান রয়েছে।
এ মামলা যে কেউ করতে পারেন। ৫৭ ধারার সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হতো মানহানির মামলাতে। যে কোনো মন্ত্রী বা সরকারি বড় নেতার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলামাত্র ওই নেতা বা মন্ত্রীর মনে হল না যে তার মানহানি হয়েছে।

কিন্তু তাদের কোনো চামচা রাঙ্গামাটি বা খুলনা থেকে যদি মনে করেন এতে মানহানি হয়েছে তবে তিনি মামলা করতে পারবেন। বা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত যে কেউ একটা মামলা করে দিতে পারেন শুধু আলোচনায় আসার জন্য বা সুযোগ নেয়ার জন্য। এর চেয়ে অদ্ভুত-বর্বরোচিত কোনো আইন দেশে হতে পারে না।
৫৭ ধারার বিধানটি এখানেও আছে। নতুন আইনে মানহানি মামলা দিয়ে যারপরনাই হয়রানি করা সম্ভব। ৫৭ ধারায় যত মামলা হয়েছে সেগুলোর কোনোটিই সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হয়নি।
অথচ সরকারি দলে যারা আছেন তারা বিরোধী দল, সুশীল সমাজ ও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অশ্লীল, অপমানজনক মিথ্যাচার পর্যন্ত করে থাকেন। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে তো কেউ মামলা করতে যায়নি। কারণ তারা জানে পুলিশ সরকারি দলের ক্ষমতাধর কাউকে গ্রেফতার করবে না।
এটা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো আইন হল না। ৫৭ ধারা অন্য নামে এনেছে তারা। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। কারণ উচ্চ আদালতে তারা প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল এটা তারা বাতিল করবে। আমি মনে করি, এ আইনের বিরুদ্ধে যে কোনো অধিকার সচেতন মানুষের রুখে দাঁড়ানো উচিত।’
এ আইনের ৩২(১) ধারায় অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের আওতাভুক্ত কিছু অপরাধ করলে বা করতে সহায়তা করলে অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা জরিমানা হবে।
২৫ ধারার (ক) উপধারায় বলা হয়, জেনে-বুঝে মিথ্যা তথ্য প্রচার করলে অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা জরিমানা হবে।
২১ ধারায় বলা হয়, ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রপাগান্ডা চালালে বা চালাতে মদদ দিলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
দেশের বিশিষ্টজনরা বলেছেন, প্রস্তাবিত ওই আইনের ২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারা বিদ্যমান থাকলে স্বাধীন সাংবাদিকতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/92776