২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২৩

ভয়ের কারণ দূর করুন

সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতিতে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন ও খসড়া ডিজিটাল আইন প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রত্যাখ্যানের কারণও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ১. এটি সংবিধানের ৩৯(২) ক ও খ ধারায় দেওয়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তার পরিপন্থী। ২. এটি চিন্তার স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ধারণার বিরোধী, যে স্বাধীনতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ। ৩. এটি গণতন্ত্রের মৌলিক চর্চারও বিরোধী, যে গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশ সব সময়ই লড়াই করেছে এবং এর পাশে থেকেছে। ৪. এটি সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মৌলিক নীতিমালার বিরোধী, যার জন্য বাংলাদেশের সাংবাদিকরা লড়াই করেছেন।
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতিতে পরিশেষে আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, যে জাতীয় সংসদ জনসাধারণ এবং জনমানুষের সব রকম স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা পূরণের স্থান, সেই সংসদ যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া পাস না করে। এ খসড়া আইন সাংবাদিকতার স্বাধীনতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

সম্পাদক পরিষদ ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত তাদের বিবৃতিতে বিস্ময়, হতাশা ও দুঃখ প্রকাশ করেছে। প্রতিবাদ, বিক্ষোভ এবং সাংবাদিক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বেগ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে বলে পরিষদ উল্লেখ করেছে। বিবৃতিতে আরো উল্লেখ করা হয়, খসড়া আইনটির ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারায় মৌলিক কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। এসব ধারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গণমাধ্যমের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুতর হুমকি। তবে ৩ নম্বর ধারার অধীনে তথ্যঅধিকার আইনের (আরটিআই) অন্তর্ভুক্তিকে পরিষদ স্বাগত জানায়, কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন (অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট) অন্তর্ভুক্ত করায় পরিষদ উদ্বেগ জানায়। কারণ এটি আরটিআই-এর সঙ্গে পরিষ্কারভাবে সাংঘর্ষিক।
আমরা জানি যে, সম্পাদক পরিষদ বিশেষ কোনো দল, মত বা রাজনীতিকে প্রতিনিধিত্ব করে না। বরং এই পরিষদ গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা এবং দেশের স্বার্থ ও গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমুন্নত রাখতে চায়। আমরা আরও জানি যে, সম্পাদক পরিষদের সদস্যদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতবৈচিত্র্য থাকলেও খসড়া ডিজিটাল আইন প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে তাঁরা ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। সরকার এর গুরুত্ব উপলব্ধি করবে বলে আমরা আশা করি।

শুধু ডিজিটাল আইনে নয়, আইনের লোকদের আচরণেও ভয়ের কারণ রয়েছে। ‘তুলে নেয়ার চার দিন পরও খোঁজ মিলছে না আরও পাঁচ তরুণের’- এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায়। ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে মুদ্রিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, হজ্ব পালন শেষে দেশে ফিরে আসা মাকে আনতে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন সহোদর শিক্ষানবিশ আইনজীবী শফিউল আলম ও বেসরকারি কোম্পানীর চাকরিজীবী মনিরুল আলম। বিমানবন্দরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মায়ের লাগেজ গাড়িতে তুলছেন দুই ভাই। হঠাৎ করেই একদল লোক এসে শফিউল আলমের নাম-পরিচয় জানতে চান। তাদের প্রশ্নের জবাবে নিজের নাম-পরিচয় দেয়ার পরই শফিউল আলম, তার ভাই মনিরুল আলম এবং তাদের এক বন্ধু আবুল হায়াতসহ তিনজনকে জাপটে ধরে অন্য একটি গাড়িতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন ডিবি পরিচয় দেয়া ওই ব্যক্তিরা। এ সময় তাদের বৃদ্ধা মা পরিচয়ধারী পুলিশদের কাছে অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন। নিজের ছেলেদের জাপটে ধরে রাখার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু ওই ব্যক্তিরা মায়ের হাত থেকে তার সন্তানদের টেনে-হিঁচড়ে তাদের গাড়িতে তুলে নেন। এর পরই গাড়ি লাপাত্তা। খোঁজ নেই ওই তিন যুবকের। শুধু ওই তিন যুবকই নয়, তাদের সঙ্গে নিয়ে ডিবি পরিচয় দেয়া লোকেরা যাত্রাবাড়ীর মিরহাজারীবাগ এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী শফিউল্লাহ এবং ডগাইয়ের একটি মাদয়াসার নবম শ্রেণীর ছাত্র মোশারফ হোসেন মায়াজকেও তুলে নিয়ে যায়। ঘটনার পর চার দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
নিখোঁজ এই পাঁচজনের পরিবারের স্বজনরা ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে (ক্র্যাব) এক সংবাদ সম্মেলনে আরো বলেন, তাদের সন্তানরা বেঁচে আছেন, নাকি তাঁদের গুম করে মেরে ফেলা হয়েছে- কিছুই জানতে পারছেন না তারা। সংবাদ সম্মেলনে শফিউল আলমের মা রামিছা খানম বলেন, তিনি গাড়ি থেকে চিৎকার করে বলেন, কেন তার ছেলেদের ধরা হয়েছে, তাদের কী অপরাধ? এ সময় পাশে থাকা আইন-শৃংখলা বাহিনীর লোকজন এগিয়ে এলে ওই ব্যক্তিরা নিজেদের ডিবির লোক পরিচয় দিয়ে আইডি কার্ড দেখান এরপর পুলিশ চলে যায়। ডিবি পরিচয় দিয়ে ওদের তুলে নেয়ার পর ওই পাঁচজনের খোঁজে অভিভাবকরা ডিবি কার্যালয় ও থানা-পুলিশের কাছে গেছেন। কিন্তু কেউ কিছু স্বীকার করছেন না।

তুলে নেয়া, গুম করা এবং হত্যার ঘটনা এখন নাগরিকদের জন্য বড় আতংকের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে রাজধানীর পূর্বাচল উপশহরের পথের ধারে গুলীবিদ্ধ তিন যুবকের লাশ নিয়ে এখনো রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে, পুলিশ পরিচয়ে তাদের যাত্রীবাহী বাস থেকে নামিয়ে অন্য গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় স্বজনদের অভিযোগ, পুলিশ তাদের নিয়ে যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিল। এভাবে নাগরিকদের তুলে নিয়ে যাওয়ায়, লাশ হওয়ার ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মানুষের জীবনতো এত শস্তা হতে পারে না। এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব রয়েছে। অভিভাবকদের অধিকার রয়েছে সন্তানদের খোঁজ পাওয়ার। এসব বিষয়ে আমরা সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের বক্তব্য আশা করছি।

http://www.dailysangram.com/post/346281