১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বুধবার, ৯:৫৮

'থাহনের জাগা নাই, পড়ালেহা করব ক্যামনে'

ভিটেমাটির সঙ্গে শিশু নাসরিন আক্তারের স্কুলটিও গেছে পদ্মার গর্ভে। তীরে দাঁড়ালে দেখা যায় স্কুলের পাকা ভবনের একটি খুঁটি উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যেও অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। নদীতে বিলীন হয়ে গেছে স্কুলটি। দাঁড়িয়ে থাকা খুঁটিটির পাশেই একটি নারকেলগাছ দেখা যায়। গাছের পাতাগুলো এখনও যথেষ্ট সবুজ রয়েছে। পদ্মার ঢেউয়ের সঙ্গে চামর দুলিয়ে নাচছে নারকেলের পাতাগুলো। পূর্ব নড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামের ওই স্কুলটি অবশ্য এরই মধ্যে পদ্মা নদীর তীরের বাঁশতলা এলাকায় অস্থায়ী কার্যক্রম শুরু করেছে। মাস খানেক পরে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী নাসরিন এখনও স্কুলে যেতে পারেনি। কেন মেয়েটিকে স্কুলে পাঠানো হচ্ছে না, জানতে চাইলে নাসরিনের বাবা সেলিম ভূইয়া বলছিলেন, 'থাহনের জাগা নাই। পড়ালেহা করব ক্যামনে? ঠিক মতন খাওন দিতে পারতাছি না, পড়ালেহা কইরা কী অইবো।'

সেলিম ভূইয়ার বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চর জুজিরা গ্রামের দুই নম্বর ওয়ার্ডে। পদ্মার ভাঙনে এবার তার ভিটেমাটি নদীতে চলে গেছে। কিছু ফসলি জমি ছিল, তা ভেঙেছে কয়েক বছর আগে। তার মেয়ে নাসরিন যে স্কুলটিতে পড়ত, সেটিও এবার নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে।

নাসরিনের স্কুলটি ছাড়াও এবার পদ্মার উত্তাল স্রোতে চর জুজিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নদীতে হারিয়ে গেছে। পাঁচগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও রয়েছে ভাঙনের ঝুঁকিতে। টানা ভাঙনের মধ্যে স্কুলগুলোর কার্যক্রম বন্ধ ছিল। সম্প্রতি ভাঙনকবলিত পদ্মার অদূরেই দুলাল ব্যাপারির একটি গুদামঘরে পূর্ব নড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চর জুজিরা স্কুলের কার্যক্রম চলছে মুলফৎগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পাঁচগাঁও স্কুলটি ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও আগের ভবনেই কার্যক্রম চালাচ্ছে। ভাঙনকবলিত এলাকার মাত্র ৪০০ মিটার দূরে রয়েছে ঢালীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাশের এলাকা মোক্তারের চরের সেবেকা গফুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও রয়েছে ভাঙনের ঝুঁকিতে। তবে স্কুলগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম চললেও ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। যা নিয়ে চিন্তিত নড়িয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্কুলগুলোর শিক্ষকরাও।

ভিটেমাটি হারানো পরিবারগুলোর শিশুরা কেন স্কুলে আসছে না, তা জানতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং তাদের কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে পরিবারগুলো উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। কেউ দূরের আত্মীয়ের বাড়ি উঠেছে, কেউ দূরের কোনো এলাকায় এক চিলতে জমি ভাড়া নিয়ে কোনো রকমে মাথা গুঁজেছে, আবার ক্ষতিগ্রস্ত অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচেই দিন গুজরান করছে। ভাঙনের মুখে পড়ে কেউ কেউ ঘরের চালা নিরাপদে সরাতে পারলেও অনেকে সন্তানের পড়ার টেবিলের দিকটায় আর নজর দিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তা গেছে নদীর পেটেই। এমন সব শিক্ষা সরঞ্জামের অভাবও দেখা দিয়েছে নদী ভাঙনের শিকার পরিবারের স্কুলগামী শিশুদের। আবার নতুন করে যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে, তাও জানে না অনেক পরিবার।

ভাঙনের শিকার ইব্রাহীম মোল্লা আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় ভূইয়াবাড়ি মাঠে। নিজের পুরনো ঘরের চালা দিয়ে কোনো রকম মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছেন। তিনি বলছিলেন, ঘরের চালা খুলে আনতে পারলেও বাকি সব আসবাব আর গৃহস্থালি পণ্য নদীতেই ভেসে গেছে। ছেলে সোহাগ চর জুজিরা স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। তার টেবিল, বই-খাতা আর আনতে পারেননি।

গত রোববার নড়িয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল আলমের সঙ্গে তার কার্যালয়ে কথা হয়। তিনি জানালেন, নদীতে ভেসে যাওয়া চর জুজিরা স্কুলটি সেমি পাকা ছিল। স্কুলের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শুরুর পরের দিনই স্কুলে ফাটল দেখা দেয়। এক পর্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ করে প্রাথমিকভাবে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ৫০ শয্যা হাসপাতালে এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। তবে হাসপাতালের একটি অংশ ভেঙে পড়লে সেখানেও শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হয়। স্কুলটি এখন মুলফৎগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে চালানো হচ্ছে।

শিক্ষা কর্মকর্তার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ওইদিনই পূর্ব নড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি যে বাড়িতে চলছে সেখানে গিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পাওয়া গেল। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ী দুলাল ব্যাপারির বাড়ির পাশে একটি গুদামঘরে বিছানা পেতে স্কুলের সব শ্রেণির শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে পাঠদান করতে দেখা গেল। বৈদ্যুতিক সংযোগ না থাকায় কিছুটা অন্ধকারের ভেতরই দু'জন শিক্ষিকা পড়াচ্ছিলেন ছাত্রছাত্রীদের। বসার জায়গা না থাকায় আরও তিনজন শিক্ষক পাশের বাড়ির পাকা সিঁড়িদরজায় বসে ছিলেন। সেখানেই রাখা আছে স্কুলের শিক্ষার্থীদের হাজিরা খাতা থেকে শুরু করে অন্যান্য কাগজপত্র। আপাতত এটাই যেন ওই স্কুলের অফিস কক্ষ।

স্কুলটির পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সিনথিয়া জানাল, চর জুজিরা গ্রামে তাদের বাড়ি ভেঙে গেছে। এখন সে বাবা-মায়ের সঙ্গে মুলফৎগঞ্জের ঋষিপাড়া এলাকায় থাকে। সেখান থেকে বর্তমান স্কুলটি অনেক দূরে হওয়ায় প্রতিদিন আসতে পারে না।

একই এলাকায় বাড়ি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুলের। সে জানাল, তাদের বাড়ি-ঘর ভেঙে যাওয়ায় কেদারপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তারা। সেখান থেকে ট্রলারে স্কুলে আসতে হয়। জান্নাতুলকে প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দিয়ে ট্রলারে অস্থায়ী স্কুলটিতে আসতে হয় বলে আতঙ্কে থাকে সে।

শ্রেণিকক্ষেই কথা হলো শিক্ষিকা জ্যোতি আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তার বাবা মারা গেছেন আগেই। এরপর তাদের কিছু জমিতে উৎপন্ন ফসল বিক্রির টাকায় মা অনেকটা যুদ্ধ করে তাকে মাস্টার্স পাস করিয়েছেন। কিন্তু এবার পদ্মার ভাঙনে জমির সঙ্গে বসতভিটাও বিলীন হয়েছে। এখন মুলফৎগঞ্জ মাদ্রাসার পাশে একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

এই শিক্ষিকা জানালেন, ওই এলাকাতে নদী ভাঙনের শিকার অনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। যাদের অনেকেই তার স্কুলের শিক্ষার্থী। তিনি অন্য শিক্ষকদের সহায়তায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে বের করে স্কুলে নিয়ে আসছেন। মুলফৎগঞ্জ থেকে বাঁশতলা পর্যন্ত সড়কটির পুরোটা নদীতে চলে যাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে উত্তাল নদীতে ট্রলারযোগে অস্থায়ী স্কুলে আসতে হয়।

স্কুলটির প্রধান শিক্ষিকা শামীমা আক্তার বলছিলেন, তার স্কুলটিতে পাকা দুটি ভবন ছিল। সীমানা প্রাচীরও ছিল। ভাঙনের মুখে আসবাবপত্র সরাতে পারলেও স্কুলের জায়গায় এখন উত্তাল নদী। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তারা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করলেও শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে ভয় পাচ্ছে। ১২৩ শিক্ষার্থীর অর্ধেকও স্কুলে আসছে না। তবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে।

চর জুজিরা স্কুলটির বর্তমান কার্যক্রম চলছে মুলফৎগঞ্জ স্কুলে। গত সোমবার সেখানে কথা হয় স্কুলের সহকারী শিক্ষক মো. সুলাইমানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তাদের মোট শিক্ষার্থীর ১২১ জনের মধ্যে অর্ধেকেরও কম শিক্ষার্থী স্কুলে উপস্থিত হচ্ছে। নদী ভাঙনে অন্যান্য আসবাবপত্রের সঙ্গে অনেক ছাত্রছাত্রীর বই-খাতাও হারিয়েছে। শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলো উদ্বাস্তু হয়েছে। এজন্য স্কুলে উপস্থিতি কম।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল আলম জানালেন, অক্টোবরের শেষের দিকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা। এজন্য তারা পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বেশি করে ক্লাসে ফেরানোর চেষ্টা করছেন। না হলে ফলাফলে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

http://samakal.com/whole-country/article/18091099