১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বুধবার, ৯:৫৪

এবারও অবহেলার শিকার ৩৬ লাখ শ্রমিক

দেশের মোট রফতানি আয়ের ৮৪ ভাগ তৈরি পোশাক খাত থেকে। এ খাতে ৩৬ লাখ শ্রমিক কাজ করলেও বরাবরই তারা অবহেলিত হয়ে আসছে। বেতন আর বোনাস নিয়ে তাদের সারা বছরই আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়। এক দিকে কর্মক্ষেত্রে সংগ্রাম অন্যদিকে সংসার জীবনের সংগ্রাম। এই দুই সংগ্রামে তাদের জীবনে সুখের দেখা আর মিলে না। পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা যৌক্তিক হয়নি। জীবনযাত্রার ব্যয় বা মূল্যস্ফীতির সাথে সমন্বয় করলে তা প্রকৃত অর্থে বেড়েছে ১ হাজার টাকারও কম। অথচ একজন শ্রমিক পরিবারের জীবনধারণের জন্য মাসিক গড় খরচ ২২ হাজার ৪৩৫ টাকা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, চূড়ান্ত বাস্তবায়নের আগে এই মজুরি আবারো সমন্বয় করা উচিত। বিপরীতে পোশাক কারখানা মালিকরা নিম্নতম এই মজুরিকেও দেখছেন বাড়তি বোঝা হিসেবে।
তিনি বলেন, মালিকদের সাথে সুর মিলিয়ে প্রতিমন্ত্রীও বলছেন এর বেশি বেতন হলে কারখানা চালানো কঠিন হয়ে যাবে। অনেক কারখানা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তার এমন বক্তব্যে আমরা হতাশ। তিনি কোনভাবেই এ কথা বলতে পারেন না। চীন কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামে আমাদের চেয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন অনেক বেশি। তাদের তো কোন সমস্যা হয় না। তাহলে আমাদের কেন সমস্যা হবে। সবার বাজার তো একই।
সুঁই সুতোয় অবিরাম স্বপ্ন বুনন এমন ৩৬ লাখ শ্রমিকের হাত ধরে এগিয়ে চলা দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক। যার মাধ্যমে আদায় হচ্ছে মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বড় এ খাতের শ্রমিকের জীবনমান আর মজুরি নিয়ে বছরের পর বছর চলে দরকষাকষি।
প্রায় ৫ বছর পর নিম্নতম মজুরি বোর্ডের পঞ্চম সভায় শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ২ হাজার ৭শ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ৮ হাজার টাকা। সিপিডির এই গবেষণা পরিচলক বলছেন, ৫ বছরে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৩২ শতাংশ। ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বা মূল্যস্ফীতির সাথে তুলনা করলে আদতে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে ১ হাজার টাকারও কম।

সিপিডির গবেষণা বলছে, একজন শ্রমিক পরিবারের জীবনধারণের জন্য মাসিক গড় খরচ ২২ হাজার ৪৩৫ টাকা। বিপরীতে আয় অর্ধেকেরও কম। ফলে ধারদেনা করেই বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে নিতে হয় শ্রমিক পরিবারগুলোকে। তাই ন্যূনতম এই মজুরি পুনর্বিবেচনার আহ্বান।
বিজিএমইএ সভাপতি বলছেন, ডিসেম্বর থেকে ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা বাস্তবায়ন হলে, টিকে থাকা অসম্ভব হবে মালিকদের। রপ্তানির শীর্ষ খাত হলেও এখনো ওষুধ, ট্যানারি, নির্মাণসহ অন্য রপ্তানিমুখী শিল্পের তুলনায় মজুরিতে সবচেয়ে পিছিয়ে পোশাক খাত।
অর্থনীতিবিদদের হিসাবে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে ৩০ শতাংশের বেশি। কিন্তু এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়েনি। এতে করে তাদের প্রতিনিয়তই বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে। অনেকেই ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছেন। তারা বলছেন এভাবে আর সংসার চালানো যায় না।
২০১৬ সালে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পর পোশাক খাতেও বেতন বৃদ্ধির জন্য বড় রকমের আন্দোলন হয়েছিল। তবে আশুলিয়ায় শুরু হওয়া এবং বেশ কয়েকদিন ধরে চলা সে আন্দোলন শেষ হয়েছিল কোন প্রতিশ্রতি ছাড়াই।

এখন নতুন মজুরি বোর্ড তৈরির খবরে শ্রমিকেরা বলছেন, তাদের ন্যুনতম বেতন বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করতে হবে। কথা হচ্ছিল ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকার একটি নামী তৈরি পোশাক কারখানার কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে।বর্তমানে চালের কেজি ৬০ টাকা, পেয়াজ ৭০ টাকা। ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করাতে পারি না।
তিনি বলছেন, একটা রুম ভাড়া যখন তিন হাজার দিতাম, তখন এই বেতনে পোষাইত। কিন্তু এখন একটা রুম ছয় সাত হাজার টাকা হইছে। আমাদের মালিক বলছে ১৫ শতাংশ বাড়াবে, আমাদের বেতনে এতে কত টাকা বাড়ে? আমরা জানিনা। কিন্তু আমরা জানি বাসা ভাড়াসহ সব কিছুর দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। সে অনুযায়ী বেতন না বাড়লে আমরা চলবো কিভাবে।
আমরা চাই ন্যূনতম মজুরি দশ হাজার টাকা করতে, আর বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা মিলিয়ে সর্বমোট ১৬ হাজার টাকা করতে হবে। তা না হলে আমাদের বেঁচে থাকাই কষ্ট।
গার্মেন্ট শ্রমিকদের অভিযোগ,সরকারি বেতন কাঠামোতে কোন কোন স্কেলে বেতন বেড়েছে ১১০ ভাগের ওপরে। তাহলে আমাদের বেতন বাড়াতে সমস্যা কোথায়। সরকারি কর্মচারিরা যে বাজারে পন্য কেনেন আমরাও তো সে বাজারে পন্য কিনি। আমরা গার্মেন্টে চাকুরি করি বলে তো আমাদের জন্য পণ্যের দাম আলাদা না। বেচে থাকার অধিকার তো আমাদেরও আছে।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরি ৩ হাজার ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৫ সালে এ খাতে ন্যুনতম মজুরি ছিল ৫৪২ টাকা।
কয়েক দফা বাড়ানোর পর সর্বশেষ ২০১৩ সালে মজুরি বাড়ানো হয়। তবে প্রতিবার বেতন বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক আন্দোলন করতে হয়েছে শ্রমিকদের। এবারই প্রথম কোন আন্দোলন ছাড়াই শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য বোর্ড গঠণে সম্মত হয়েছে মালিক পক্ষ।

শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, ইতিমধ্যেই বিভিন্ন আলোচনায় মালিকপক্ষ ন্যুনতম মজুরি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। তবে, একে খুবই অপ্রতুল বলে বর্ণণা করছিলেন শ্রমিকদের একটি সংগঠন গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার।
২০১৩ থেকে ২০১৮র মধ্যে সব কিছুর দাম অনেক বেড়ে গেছে। যেকোন শ্রমিকের জন্য এখন যা বেতন পান তারা, সংসার চালানো কঠিন। মালিকেরা বলছেন ২০ শতাংশ মজুরি বাড়াবেন। আজকে দেখেন জাহাজ ভাঙা শিল্পেও ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ হাজার টাকা।
তবে, মজুরি বৃদ্ধির জন্য তৈরি পোশাক শ্রমিকেরা আন্দোলন করেনি, এমন বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করলেন জলি তালুকদার। এবার কোন আন্দোলন ছাড়াই গার্মেন্টস মালিকরা বেতন বৃদ্ধির জন্য বোর্ড গঠন করতেক রাজি হয়েছেন। তবে তারা যে মজুরি ঘোষনা করেছে তা যদি পুর্ন বিবেচনা না করা হয় তাহলে ১৬ সালের চেয়ে আরও কঠোর আন্দোলন হতে পারে।

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন শ্রমিকদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। বেঁচে থাকতে হলে আন্দোলন করা ছাড়া তাদের সামনে কোন পথ খোলা নেই। শ্রমিকদের মত উপেক্ষা করেই এই মজুরি নির্ধারন করা হয়েছে। যা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি।
তিনি বলছেন, সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে নিয়মিত আন্দোলন চালিয়ে আসছে শ্রমিকেরা। তবে, এখন আর আগের মত রাস্তায় অবরোধ বা ভাঙচুর হয় না বলে দাবি করেছেন তিনি।
তৈরি পোশাক রপ্তানীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। এ খাতে কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারসহ বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্ধি দেশগুলোর অনেকেই শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলছেন, মজুরি নির্ধারণের প্রস্তাব তারাই দিয়েছেন, কিন্তু সেটি প্রদানের ক্ষেত্রে মালিকদের সামর্থ বিবেচনায় নিতে হবে।
এখানে মজুরি ঠিক করতে হবে কারখানার সক্ষমতা অনুযায়ী। ধরুন আপনি একটা মজুরি ঠিক করলেন দিতে পারলেন না। কারখানা বন্ধ হয়ে গেল, তখন কি হবে? ওয়েজ বোর্ড হলে তারাই ঠিক করবে, কত কি দেয়া যায়। সে অনুযায়ী আমরা মজুরি দেব।

কারণ পুরো পৃথিবীতে এখন অ্যাপারেল পন্যের চাহিদা দিনদিন কমে যাচ্ছে, দামও কমে যাচ্ছে। সেখানে টিকে থাকাই মুশকিল। এর ওপর গত দুই বছরে আমাদের আটশো থেকে এক হাজার কারখানা বন্ধ হয়েছে।
তাছাড়া কমপ্লায়েন্স নিয়ে এক ধরণের চাপের মধ্যে আমরা আছি। এরকম নানা ইস্যু নিয়ে আমাদের অবকাঠামোগত কিছু দুর্বলতা আমাদের এখনো আছে।
যে নতুন মজুরি বোর্ড তৈরির কথা রয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যে সেটি নতুন মজুরি কার্যকর করবে এবং শ্রমিকেরা ডিসেম্বর থেকেই নতুন নির্ধারিত মজুরি অনুযায়ী বেতন পাবেন। বলা হয়ে থাকে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশেই সর্বনিম্ন মজুরি প্রদান করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এ খাতে এই মুহূর্তে ৪৪ লক্ষ মানুষ কাজ করছে।

http://www.dailysangram.com/post/346125