১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১২:৩১

প্রকল্প অনুমোদনের হিড়িক শেষ সময়ে

চলতি মেয়াদে বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের হিড়িক পড়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সমীক্ষা ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে প্রকল্প অনুমোদন। ভোটারদের মন জয় করতে শেষ সময়ে এসে সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ আসনের অবকাঠামো উন্নয়নে দেওয়া হচ্ছে অর্থ। বাদ পড়ছেন না নবনির্বাচিত মেয়ররাও। আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় একনেক বৈঠকের জন্য তৈরি করা আলোচ্যসূচিতে ৯টি প্রকল্প থাকলেও এ সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমিত আকারে ব্যবহারের জন্য বহুল আলোচিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্প। গত রবিবার জারি করা একনেকের আলোচ্যসূচিতে প্রকল্পটির নাম উল্লেখ না থাকলেও আজকের সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য উঠছে বলে নিশ্চিত করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। খুলনা সিটি করপোরেশনে সদ্য বিজয়ী মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের জন্য রয়েছে বিশেষ উপহার। নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীও সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থ পাচ্ছেন। আজকের একনেক সভায় আলোচ্যসূচির বাইরে খুলনা সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো উন্নয়নে দুটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হচ্ছে।

এ ছাড়া সারা দেশে ১০০ মিটারের নিচে সেতু নির্মাণ ও সংস্কারে থাকছে আলাদা একটি মেগা প্রকল্প। কিন্তু কোন জেলায় কতটি সেতু নির্মাণ এবং সংস্কার করা হবে, তা চূড়ান্ত না করেই প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রকল্পটি নিয়ে অনিয়মের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে ভারত ও মিয়ানমার থেকে পাওয়া এক লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকায় মৎস্যসম্পদসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্য আহরণে নেওয়া মেগা একটি প্রকল্পও একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য সরাসরি উত্থাপন করা হচ্ছে। বিসিএস ইকোনমিক ক্যাডারদের জন্য একটি একাডেমিক ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্প উঠছে আলোচ্যসূচির বাইরে। নতুন চার লেন সড়ক, রেললাইন নির্মাণ ও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পও থাকছে। ২৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে কোনো প্রকল্প নেওয়া হলে সেই প্রকল্পের সমীক্ষা করা আবশ্যক হলেও এসব প্রকল্পের সমীক্ষা করা হয়নি। সব মিলিয়ে আজকের একনেক বৈঠকে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হতে পারে। এর আগে গত ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ওই সব প্রকল্পের ব্যয় ছিল প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা।

রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া এসব প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, ভোটারদের মন জয় করতে সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ আসনের অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থ দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে ভোটারদের আকর্ষণের চেষ্টা থাকবে ক্ষমতাসীনদের। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন নতুন প্রকল্প না নিয়ে বরং পুরনো প্রকল্পগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। এতে আর্থিক অপচয় কিছুটা হলেও কমবে। কারণ সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে এত বিশাল বাজেট তৈরি করা সম্ভব হবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেকোনো সরকারের শেষ সময়ে এসে প্রকল্প অনুমোদনের সংখ্যা বেড়ে যায়। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। এসব প্রকল্প নেওয়ার উদ্দেশ্য থাকে ভোটারদের কাছে টানা। রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া এসব প্রকল্পে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে শেষ হয় না। এতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। আবার প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়ে যায়। ফলে কাজের গুণগত মান নিশ্চিত হয় না। মানুষও প্রকল্প থেকে সুফল পায় না।’

গতকাল সোমবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ঘুরে দেখা গেছে, কর্মকর্তাদের দম ফেলার ফুরসত নেই। গত শুক্রবার ও শনিবার ছুটির দিনও কয়েকজন কর্মকর্তা অফিসে এসে প্রকল্প প্রক্রিয়া করতে কাজ করেছেন। গতকাল খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দেখা গেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ঘোরাঘুরি করতে। উদ্দেশ্য, আজকের একনেক সভায় যেভাবেই হোক প্রকল্প ওঠাতে হবে। কর্মকর্তারা যাতে সব প্রক্রিয়া শেষ করেন সেই তাড়া দিতেও দেখা গেছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দুটি প্রকল্প আজ আলোচ্যসূচির বাইরে একনেক সভায় উঠছে।
সরকারের শেষ সময়ে এসে প্রকল্প অনুমোদনে কেন এত তোড়জোড় জানতে চাইলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, নির্বাচনকালীন সরকার অক্টোবরের মধ্যে গঠিত হতে পারে। সময় আছে আর মাত্র এক মাস। নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী আর একনেক বৈঠক হওয়ার সুযোগ নেই। তখন শুধু রুটিন কাজ হবে। নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের আগে প্রকল্প অনুমোদনের চাপ বাড়ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে। একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংকেরও তাগিদ আছে তাদের প্রকল্পগুলো দ্রুত অনুমোদনের জন্য।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য মতে, আজকের একনেক সভায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দুটি মেগা প্রকল্প আলোচ্যসূচির বাইরে অনুমোদনের জন্য তোলা হচ্ছে। একটি হলো, ১০০ মিটারের নিচে গ্রামীণ সেতু নির্মাণ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ দিচ্ছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। বাকি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া হবে। আরেকটি হলো, ভারত ও মিয়ানমার থেকে পাওয়া সমুদ্র সম্পদের ওপর সামুদ্রিক মাছ আহরণ প্রকল্প। এটি বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে এক হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ দিচ্ছে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বাকি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া হবে।
অন্যদিকে খুলনার নবনির্বাচিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক সড়ক অবকাঠামো ও জলাবদ্ধতা দূর করতে মোট এক হাজার ৪৩০ কোটি টাকা পাচ্ছেন। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা ও ড্রেনেজব্যবস্থার উন্নয়নে পাচ্ছেন ৮২৩ কোটি টাকা। আর খুলনা সিটি করপোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা উন্নয়নে পাচ্ছেন আরো ৬০৭ কোটি টাকা। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো উন্নয়নে ৪৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পও আজ একনেকে উঠছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মহলের বিরোধিতার পরও আজকের একনেক সভায় এসংক্রান্ত প্রকল্পটি ওঠানো হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হবে তিন হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় দেড় লাখ ইভিএম কেনার কথা রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এমনিতেই প্রকল্পের সংখ্যা বেশি। তার ওপর সরকারের শেষ সময়ে এসে নতুন নতুন প্রকল্প অনুমোদন মানে হলো এডিপিতে আরো চাপ তৈরি হওয়া। কারণ আমাদের দেশে কোনো প্রকল্প ঠিক সময়ে শেষ হয় না। তাই আমাদের উচিত, নতুন প্রকল্প না নিয়ে পুরনো প্রকল্প শেষ করার দিকে নজর দেওয়া।’

 

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/09/18/681484