১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১২:৩০

সর্বনিম্ন ছেড়ে চতুর্থ দরদাতাকে কাজ!

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস (বিএসও) কাগজ কেনার ক্ষেত্রে বারবার অনিয়মের আশ্রয় নিচ্ছে। সিটি করপোরেশন ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী মুদ্রণ কাজের কাগজের দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে চতুর্থ দরদাতাকে কাজ দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। আর চতুর্থ দরদাতা প্রতিষ্ঠান বিদেশি নিম্নমানের কাগজ সরবরাহ করবে বলে জানা গেছে। এতে একটি দরপত্রেই সরকারের গচ্চা যাবে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা। অন্যদিকে দেশীয় শিল্পও ক্ষতির মুখে পড়বে।

বিএসও সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশন ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী মুদ্রণ কাজের জন্য ৫৩ হাজার ২২৭ রিম কাগজ কিনতে সম্প্রতি দরপত্র আহ্বান করা হয়। গত ৯ আগস্ট দরপত্র খোলা হয়। সেখানে দেখা যায়, সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান প্রতি রিমের দর দিয়েছে দুই হাজার ২৩১ টাকা। সেই হিসাবে তারা মোট দর দিয়েছে ১১ কোটি ৮৭ লাখ ৪৯ হাজার ৪৩৭ টাকার। এরপর দ্বিতীয় দরদাতা প্রতিষ্ঠান মোট দর দিয়েছে ১৩ কোটি ৯৭ লাখ ২০ হাজার ৮৭৫ টাকা। তৃতীয় দরদাতা প্রতিষ্ঠান মোট দর দিয়েছে ১৭ কোটি ৯৮ লাখ ৫৪ হাজার ৩৩ টাকা। আর চতুর্থ দরদাতা প্রতিষ্ঠান মোট দর দিয়েছে ১৯ কোটি ৪৯ লাখ ৭০ হাজার ৫০১ টাকা। আরো দুটি প্রতিষ্ঠান এর চেয়েও বেশি দর দিয়েছে।
জানা যায়, বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে চতুর্থ দরদাতাকে কাজ দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। এতে সরকারের গচ্চা যাবে সাত কোটি ৬২ লাখ ২১ হাজার ৬৪ টাকা। চতুর্থ দরদাতা প্রতিষ্ঠান আমদানি করা কাগজ সরবরাহ করবে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়া বিদেশি পণ্য আমদানি ও বাজারজাত করলে জেল-জরিমানাসহ অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। তাই অবৈধভাবে নিম্নমানের বিদেশি কাগজ কিনলে আইনের সরাসরি লঙ্ঘন হবে। কারণ চতুর্থ দরদাতা প্রতিষ্ঠান বিদেশি কাগজ সরবরাহ করবে। অভিযোগ উঠেছে, বিএসও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হয়েও সরকারের নিয়ম-নীতি মানছে না। এতে একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী লাভবান হলেও দেশের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হবে।
দেশীয় কাগজ শিল্প মালিকদের দাবি, দরপত্রের সঙ্গে দাখিল করা কাগজের নমুনা বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে পরীক্ষা করানো হোক। কাগজের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন; যেমন—জিএসএম, ব্রাস্টিং ফ্যাক্টর, ব্রাইটনেস, স্মুথনেস, ক্যালিবার, ওপ্যাসিটি ইত্যাদি বিষয়ে পরীক্ষা করে কাগজের গুণগত মান এবং তুলনামূলক দর বিবেচনায় নিয়ে কাগজ কেনার ব্যবস্থা করা হোক।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) পক্ষ থেকে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসে চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের কাগজশিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্প খাত। দেশে বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০৬টি পেপার মিল রয়েছে। এসব পেপার মিলে বর্তমানে বিশ্বমানের সব ধরনের কাগজ উৎপাদিত হয়, যা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিদেশি কাগজের সমকক্ষ। বিএসওর দরপত্রের মাধ্যমে কেনা দেশীয় উন্নত মানের কাগজ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া টাঁকশাল, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ দেশের সব শিক্ষা বোর্ড, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক কম্পানিতে সুনামের সঙ্গে দেশি কাগজ ব্যবহৃত হচ্ছে। বিপিএমএর সদস্যভুক্ত মিলগুলোতে উৎপাদিত আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কাগজ বর্তমানে অস্ট্রোলিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। এ খাতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদন করে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে এই শিল্প খাত জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

অথচ বিএসও নির্বাচনী কাজে বেশি দাম দিয়ে বিদেশি কাগজ কেনার পাঁয়তারা করছে। অথচ আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-২০১৮-এর ধারা ২৮(ক) বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মান (বিডিএস) অনুযায়ী আমদানি করা কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য খালাসের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে অসাধু আমদানিকারকরা মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বেআইনিভাবে নিম্নমানের কাগজ আমদানি করছে। এতে একদিকে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে; অন্যদিকে অসম প্রতিযোগিতার কারণে দেশীয় কাগজ শিল্পের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার যেখানে নিম্নমানের পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে, সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি স্টেশনারি অফিস বিএসটিআইয়ের মান সনদ ছাড়া আমদানি করা কাগজ সংগ্রহ করে দেশের আইন-কানুনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে। তাই কাগজ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ব্র্যান্ড ও দেশের নাম উল্লেখ না করে সঠিক মানের কাগজ চাওয়া উচিত।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সাদিক হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনী কাগজের দরপত্রের বিষয়টি এখন ক্রয় কমিটির হাতে রয়েছে। তবে নির্বাচনী কাজে সাধারণত বিদেশি কাগজই পছন্দ করা হয়। দেশি কাগজ ভালো হলেও তাদের কোয়ালিটি ম্যাচ করে না। এ ছাড়া যাঁরা এই কাগজ ব্যবহার করবেন তাঁদেরও একটা পছন্দ থাকে।’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2018/09/18/681492