১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১২:২৮

চারদিকে লাশ আতঙ্ক

নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে থানায় জিডি গ্রহণ না করার অভিযোগ
৬ দিনেও খোঁজ মেলেনি দুই সহোদরসহ নিখোঁজ পাঁচজনের
নিখোঁজ ও গুলির ঘটনায় জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা উচিত -নূর মোহাম্মদ

নিরন্ত্র মানুষকে হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা ও নিখোঁজের ঘটনায় আতংক বাড়ছে চারদিকে। একের পর এক গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনায় জড়িতরা থেকে যাচ্ছে বহাল তবিয়তে। এ ধরনের ঘটনা সম্প্রতি বেড়ে যাওয়ায় শুধু খুন বা অপহৃত ব্যক্তির স্বজনরাই নয়, দেশের সবর্স্তরের মানুষের মধ্যেই আতংক ছড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊধ্বর্তন কমর্কতাদের শঙ্কা, বিশেষ কোনো দুবৃর্ত্ত সিন্ডিকেট পুলিশের সুনাম ক্ষুন্ন করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে এ ধরনের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। তবে তারা বলছেন, তাদের কাছে এ ধরনের লাশ উদ্ধার বা অপহরণের যতগুলো অভিযোগ আসছে, তারা প্রতিটি অভিযোগই গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছেন।

গত ১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রূপগঞ্জে পূর্বাচল উপ-শহরের আলমপুরা এলাকার ১১ নম্বর ব্রিজের নিচ থেকে সোহাগ (৩৫), শিমুল আজাদ (২৬) ও নূর হোসেন বাবু (২৬) নামে তিন যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্বজনদের অভিযোগ, ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওই তিন যুবককে উঠিয়ে নিয়ে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে গত ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে যশোরের শার্শার সামটা গ্রামের মেহগনিতলা ও কেশবপুরে উপজেলার ধর্মপুর গ্রামের রাস্তার পাশ থেকে পুলিশ আপন দুই ভাই ফারুক হোসেন (৫০) ও আজিজুল হকের (৪৫) গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোষাকধারীরা দুই ভাইকে সামটা বাজারের কাছ থেকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা হয়েছে বলে পরিবারের অভিযোগ। গুলিবিদ্ধ এসব লাশ উদ্ধারের ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ক্লু উদ্ধার বা জড়িতদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। অন্যদিকে ৬ দিনেও খোঁজ মেলেনি দুই সহোদরসহ নিখোঁজ পাঁচজনের। থানা, ডিবি কার্যালয়, র্যা ব কিংবা মর্গ জীবিত অথবা মৃত কোথাও তাদের সন্ধান নেই। কান্না থামছে না উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় নিমজ্জিত নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের। তবে পুলিশ বলছে, তাদের হেফাজতে নেই নিখোঁজ ৫ ব্যক্তি। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি গ্রহণ না করার অভিযোগ করেছেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা উচিত নয়। হুটহাট করে গ্রেফতার করলে সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি হয়। যদি অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতার করা হয় আইনশ্ঙ্খৃলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত দ্রুত সেসব অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ করা।

পুলিশের সাবেক আইজিপি ও সাবেক সচিব নূর মোহাম্মদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, প্রতিটি ঘটনাই পুলিশ তদন্ত করছে। একই সাথে এসব ঘটনার সাথে পুলিশ জড়িত থাকার কথা স্বীকার করছে না। তবে জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে বের করা এবং গুলি করে হত্যার পর লাশ ফেলে রাখার সাথে জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা উচিত।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মোঃ সোহেল রানা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার বা নিখোঁজের ঘটনা নিয়ে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। প্রতিটি ঘটনাই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ সদরদফতর থেকে প্রতিটি ঘটনা মনিটরিং করা হচ্ছে। এ জন্য একাধিক টিম কাজ করছে।
পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা সম্প্রতি বেড়ে যাওয়ায় এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে এআইজি মোঃ সোহেল রানা বলেন, পুলিশের নিয়মিত কাযর্ক্রমের মধ্যে দিয়ে এ ধরনের ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব। তবে বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে যদি তা প্রয়োজন হয় তবে তাৎক্ষণিকভাবেই সে উদ্যোগ নেয়া হবে। বিশেষ কোনো দুবৃর্ত্ত সিন্ডিকেট পুলিশের সুনাম ক্ষুন্ন করে নিজেদের স্বাথ হাসিলে এ ধরনের অপতৎপরতা চালাচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

আইন-শৃংখলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, যশোরের বাঘারপাড়া এলাকার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ৩ আগস্ট সন্ধ্যায় পুলিশ পরিচয়ে এক যুবলীগ নেতাকে তুলে নেয়ার ৫ দিন পর নড়াইলে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ১২ আগস্ট চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি আলতাফ হোসেনকে প্রকাশ্য সালিশি বৈঠক থেকে ডিবি পরিচয়ে অপহরণের ১৫ ঘণ্টা পর তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় রাস্তা সংলগ্ন ঝোপের ভেতর। অন্যদিকে গত ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পযর্ন্ত মাত্র এক সপ্তাহে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে এক আইনজীবী ও দুই শিক্ষাথীর্সহ ৫ জন এবং সিলেটে এক চিকিৎসকসহ তিন যুবককে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
মতিঝিলের ব্যবসায়ী সৈয়দ মুজাহিদুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমার কলেজ পড়ুয়া দুই ছেলেকে নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছি। দিনে একাধিকবার ফোন করে তাদের খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করছি। সব সময় আতংকের মধ্যে থাকতে হচ্ছে।

জানা গেছে, সহোদর শাফিউল আলম ও মনিরুল আলমের কথা মনে হলেই অস্থির হয়ে পড়ছেন তাদের মা রমিছা খানম (৭৫) ও বাবা মোশারফ হোসেন (৯০)। নানা উৎকণ্ঠায় ৬দিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তারা। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করতে পারছেন না। অনেকটা একই অবস্থা তাদের সঙ্গে একই রাতে নিখোঁজ হওয়া আবুল হায়াত, মোশারেফ হোসাইন মায়েজ ও শফিউল্লাহ মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সদস্যদের। হাসপাতাল, আদালত, ডিবি অফিস, থানা কোথাও খুঁজতে বাদ রাখেননি তারা। প্রকৃতপক্ষে নিখোঁজ ব্যক্তিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে আছেন, নাকি ডিবি পরিচয়ে তাদের অন্য কেউ তুলে নিয়ে গেছেন তারা এটি নিশ্চিত হতে চান।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/154103