১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৪১

ইভিএম চালু করা মানে নির্বাচন কলুষিত করা-বিশেষজ্ঞমহল

শত বিতর্ক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও বিতর্কিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনার কার্যক্রম চূড়ান্ত করা হচ্ছে। আজ মঙ্গলবার একনেক সভায় দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে বলে পরিকল্পনামন্ত্রী জানিয়েছিলেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটগ্রহণে এগুলো ব্যবহারের পদক্ষেপ নিতেই এ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ জন্য তিন হাজার ৮২৯ কোটি সাত লাখ টাকা ব্যয় হবে। ভোটিং এই পদ্ধতির ব্যবহার নিয়ে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই বিরোধ চলছে। অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন, সব দল যখন নির্বাচনমুখী তখন হঠাৎ করে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক দলকে নির্বাচনবিমুখ করার চেষ্টা হতে পারে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি ছাড়াই এই মুহূর্তে ইভিএম চালু করা বাংলাদেশের অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন কলুষিত করা ছাড়া কিছু নয়।

প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে সুষ্ঠু, অবাধ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইসি কর্তৃক প্রকল্পটি গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ইভিএম যুক্ত হলে সামগ্রিক ভোট গ্রহণ প্রক্রিযায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতন্ত্র সমুন্নত হবে। এখানে শুধু দেড় লাখ সেট ইভিএম কেনার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৫১৫ কোটি ৬০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর তিন হাজার ১১০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, যাতে ব্যয় হবে পাঁচ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণে বছরে ব্যয় হবে এক কোটি টাকা। কম্পিউটার সফটওয়্যার কেনার জন্য ব্যয় হবে ৫০ কোটি ৯০ লাখ টাকা। প্রতিটি সফটওয়্যারের দর পড়বে আট কোটি ৪৮ লাখ টাকা। অপ্রত্যাশিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ কোটি ৭৫ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। পরামর্শক খাতে ব্যয় হবে ছয় কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
ড. শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন সাবেক নির্বাচন কমিশন প্রথমবার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে। প্রথম পর্যায়ে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ১১ হাজার ৫৫৬ টাকা দরে ১৩০ ইউনিট ইভিএম সংগ্রহ করে ওই কমিশন। দ্বিতীয় ধাপে একই প্রতিষ্ঠান থেকে ৩২ হাজার ৫৪৭ টাকা দরে ৪০০টি ও তৃতীয় পর্যায়ে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) থেকে ৪৬ হাজার ৫০১ টাকা দরে ৭০০টি সব মিলিয়ে এক হাজার ২৩০ ইউনিট কিনেছিল সেই কমিশন। আর এবার প্রতি ইউনিট ইভিএমের দাম পড়ছে প্রায় দুই লাখ টাকা। এই সব ইভিএম দেশের বিভিন্ন উপজেলা, ইউনিয়ন ও সিটি নির্বাচনে ব্যবহার করা হয়েছিল সেখানেও অনেক বিতর্ক উঠে।

প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ইভিএম পদ্ধতি প্রথম চালু হয় যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০ সালে। তবে পৃথিবীর ৯০ শতাংশ দেশে ই- ভোটিং পদ্ধতি নেই। যে কয়েকটি দেশ এটি চালু করেছিল, তারাও এখন এটি নিষিদ্ধ করেছে। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল ভোট ইভিএমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট ইভিএমে সম্পন্ন তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করে। ড. অ্যালেক্স হালডারমেন নামে এক প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞ ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের ওপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছিলেন, আমেরিকায় ইভিএম কারচুপির প্রতিরোধক (টেম্পার প্রুফ) নয়। ফলে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যেও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আমেরিকার ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাকিগুলোতেও তা নিষিদ্ধ হওয়ার পথে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের মতে, সবাই একবাক্যে বলেছেন এখন এটার ব্যবহার সম্ভব নয়। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও একই কথা বলেছেন। তারপরও কেন তড়িঘড়ি করে এটি কেনার প্রকল্প অনুমোদনের প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে? তিনি বলেন, মেশিনের সাথে কারো কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু নির্বাচনের কয়েক মাস আগে তাড়াহুড়া করে এটি করার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় দেখা দিতে পারে। এমনকি এই মেশিনকেই বিতর্কিত করা হবে। তিনি বলেন, অনেক দেশই এটি শুরু করে আবার স্থগিত করেছে। এমনকি ভারতেও ইভিএম নিয়ে বিতর্ক চলছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের মতে, ইভিএম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ সারা দেশে বিদ্যুৎ এখনো পর্যাপ্ত নয়। ইভিএম চালাতে হলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া ইসি এখনো বড় কিছু বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। সে কারণে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালু করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, তাড়াহুড়া করে এটি করাও ঠিক হবে না।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে, নির্বাচন ঘনিযে এসেছে। এই মুহূর্তে ইভিএম কেনার কোনো প্রশ্নই আসে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই ইভিএমের প্রয়োগ করতে হলে ইসির কর্মকর্তা ও ভোট সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেটি না করে এখন এই প্রকল্প নেয়া এবং ইভিএম কেনাটা যৌক্তিক নয়। এই উদ্যোগে নানান প্রশ্নের সৃষ্টি হতে পারে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/350031