১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:১৮

ময়দানের সরকারি নিয়ন্ত্রণ সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টি নয়

জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে দেশের অবস্থা ততই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ বলছেন যে, ১৭ কোটি মানুষ চরম বিপর্যয়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে। সময় ফুরিয়ে আসছে। আগামী সাড়ে তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশে কি ঘটতে যাচ্ছে তা জানতে সকলেই উদগ্রীব। দেশে-বিদেশে সকলেই চাচ্ছেন সকল দলের অংশ গ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। বিষয়টি জাতিসংঘ পর্যন্ত গেছে। বিএনপি প্রতিনিধিরা সংকট সমাধানে মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তারা ভারত সফর করেছেন। তাদের কাছে সম্ভবত খুব বেশি আশ্বাস পাননি। জাতিসংঘ মহাসচিবের সহায়তা কামনা করেছেন। মহাসচিব সাড়া দিয়েছেন। তিনি সহকারী মহাসচিবকে তাদের কথা শুনতে বলেছেন। বিএনপি সেক্রেটারি জেনারেলের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে নিউইয়র্ক সফর করে তার সাথে বৈঠক করেছেন। সরকারি দল এ নিয়ে অনেক ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপও করছেন। পরাধীন ভারতে হাইকোর্ট সুপ্রীম কোর্টে ন্যায়বিচারে বঞ্চিত হলে বিক্ষুব্ধ ভারতবাসীদের প্রিভি কাউন্সিলে যাবার ব্যবস্থা ছিল। এখন স্বাধীন বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মৌলিক অধিকার তথা ভোটাধিকারসহ স্বাধীন চলাফেরা ও কর্মতৎপরতার অবস্থা এতই খারাপ হয়ে গেছে যে, সরকারি সন্ত্রাস, অত্যাচার, অবিচার এবং হত্যা গুমের ও নির্বিঘেœ ভোট দেয়ার অধিকার ফেরত পাবার জন্য আমাদের ভিন্ন দেশ এবং জাতিসংঘের দুয়ারে ধর্না দিতে হচ্ছে। তারা এখন প্রিভি কাউন্সিলের আসনে বসেছে। কী চমৎকার। মীর্জা আলমগীর গংয়ের জন্য আমার এখন ভয় হচ্ছে। তারা জাতিসংঘের কাছে নালিশ করার মত স্পর্ধা দেখিয়ে পরম পরাক্রমশালী সরকারের রাজত্বে ফিরে আসা এবং তাদের সহ্য করার মত মনোবৃত্তি থাকা খুবই কঠিন ব্যাপার।

গতকাল ব্যানার হেডিংয়ে সহযোগী একটি দৈনিক খবর দিয়েছে যে, মাঠ নিয়ন্ত্রণে রেখে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন করতে চায়। এ উদ্দেশ্যে তারা একদিকে দল ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোকে সক্রিয় রাখছেন, অন্যদিকে জোট শরীকদেরও মাঠে নামাচ্ছেন, যাতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট সরকার বিরোধী কোন তৎপরতায় অংশ নিতে না পারে। পুলিশ বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও সরকার সতর্ক অবস্থায় রাখছেন। ক্ষমতাসীন দলের জেলা নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ পুলিশ বাহিনীকে তাদের নির্দেশ মত বিরোধী রাজনীতিকদের দমন-নিপীড়নের আদেশ দিতেও দেখা যাচ্ছে এবং তাতে ব্যর্থ হলে চাকরি ছাড়ারও পরামর্শ দিচ্ছেন। সম্প্রতি দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি জেলার এক সমাবেশে আওয়ামী লীগ জেলা সভাপতির এক ভাষণ সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। আবার সরকারি নির্দেশে বিরোধী দল দমনে পুলিশের নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মসূচির কথা তো দেশবাসীর জানাই আছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের লোকেরা প্রতিনিয়ত গ্রেফতার হচ্ছেন। তারা নিজ বাড়ি, অফিস, পাবলিক প্লেস কোথাও একত্রিত হতে পারছেন না। নাশকতা সৃষ্টির গায়েবী অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ৬৮ হাজার গ্রামে নেটওয়ার্ক আছে এমন দল এদেশে তিনটি। আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এরশাদের জাতীয় পার্টির অবস্থা এক সময় ভাল ছিল, এখন ক্ষয়িষ্ণু। দেশের সর্বত্র তাদের বিচরণ নেই। অন্যদলগুলো বেশিরভাগই এলাকা ভিত্তিক ও সাংগঠনিক কাঠামো প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি। এরশাদ স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিপরায়ন ছিলেন। তার সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও জামায়াত যৌথভাবে আন্দোলন করেছে এবং ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার নৈতিক চরিত্র নিয়েও দেশবাসীর আপত্তি রয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এরশাদ ও তার দলকে ক্ষমতাসীন জোটের অংশিদার করে নিজের স্বৈরাচারী সরকারকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন। বিএনপি-জামায়াতকে দলীয় ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে ঠেলে দিয়ে গ্রেফতার নির্যাতন করে, এমনকি বাড়ি ছাড়া করে মাঠ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভোট নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করছেন। ২০১৪ সালে তার পরিকল্পনা সফল হয়েছে। ঐ সময়ে বিনা ভোটে নির্বাচিত তার সরকার টিকে যাওয়ায় তার দল উৎফুল্ল। তারা আশা করছেন, এবারও একই পদ্ধতিতেই জয়ী হয়ে হ্যাটট্রিক করবেন। এই উদ্দেশ্যে জনদাবি উপেক্ষা করে তারা এগিয়ে চলছেন, যে কোন রকম সংলাপ উপেক্ষা করছেন এবং দেশ-বিদেশের মানুষের চোখে ধুলা দেয়ার জন্য নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা বলছেন। তারা বলছেন যে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিধান সংবিধানে নেই। এটি একটি ভাওতা। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাংলাদেশের সংবিধানের একটি অংশ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার ক্ষমতায় আসার জন্য অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সংবিধান থেকে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। এখন নির্বাচনকালীন সরকারের নামে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সরকারের কথা বলা হচ্ছে তা বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও নেই। যে আদালতের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ বাতিল করেছিল সেই আদালতের রায়ে আরো দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু রাখার অনুকূলে মত প্রকাশ করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে একটি সংসদীয় কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করেছিল। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং আইনজ্ঞদের মতামত নেয়া হয়েছিল। তাদের সকলেই এমনকি সরকারের একাধিক মন্ত্রীও এই বিধান বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। কমিটির প্রধান শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন যে, কেয়ারটেকার পদ্ধতি বহাল থাকবে। কিন্তু সংসদীয় কমিটি যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলো তখনই সব উল্টে গেল। সকল মতামত উপেক্ষা করে তার মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করা হলো এবং এভাবে দেশকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেয়া হলো। বহু রক্তের বিনিময়ে এই দেশে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা হিসেবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধয়ক সরকার পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। এটি ছিল একটি মীমাংসিত ইস্যু। এই পদ্ধতিকে ধ্বংস করে আওয়ামী লীগ সরকার আরো মারাত্মক ও জটিল ইস্যুর জন্ম দিয়েছে। এই জটিলতা এবং জন ইচ্ছাকে উপেক্ষা করার কারণে ২০১৪ সালে আন্দোলন হয়েছে। পুলিশের গুলীতে এবং সংঘর্ষে ছয় শতাধিক লোক নিহত এবং হাজার হাজার লোক আহত হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে। এবার কি হবে? সরকারের মন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ নেতারা গত কয়েক বছর ধরেই উপহাস করে আসছেন যে আন্দোলন করার মুরোদ বিএনপির নেই। তারা সম্ভবত এ কথা বলতে পারছেন না যে, আন্দোলন দমন করার জন্য দলীয় ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে আমরা যে পারঙ্গমতা ও নৃশংসতা দেখিয়েছি তা আর কেউ পারেনি।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী সংলাপের জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম জিয়াকে বঙ্গভবনে মধ্যাহ্ন ভোজের দাওয়াত দিয়েছিলেন। এ বছর সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। আবার সংলাপ করবেন কার সাথে? বেগম জিয়া তো জেলে। তিনি বিরোধী দলের নেতা নন, প্রতিদ্বন্দ্বী ২০ দলীয় জোটের নেতা। বিরোধীদলীয় নেতা হচ্ছেন রওশন এরশাদ, যিনি নিজেকে গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা বলে মনে করেন। গৃহপালিত তো বটেই। দুনিয়াতে কি এমন দল আছে যে দলের নেতারা একই সাথে পার্লামেন্টে ট্রেজারি বেঞ্চ এবং অপজিশন বেঞ্চে বসেন? তারা মন্ত্রীত্ব করেন আবার বিরোধী দলের সদস্য বলেও নিজেদের দাবি করেন? এরাই এরশাদের জাতীয় পার্টি। এদের এবং রাজনৈতিক এতিম বলে কথিত বাম ধারার গণবিচ্ছিন্ন কয়েকটি দলের প্রতিনিধিদের আওয়ামী ছাতার নিচে এনে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী তার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে চান। অমসৃণ মাঠে আবার নির্বাচনী প্রচেষ্টা হবে এটা কি দেশবাসী মানবে? এই নির্বাচনকে ঘিরে একটি আন্দোলন অবধারিত বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। সরকার এবং তার সহযোগীরা আন্দোলন হলে তা সহিংস হবার জিগির তুলে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। এ জন্য পুলিশের তরফ থেকে আগাম ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। আনসার-ভিডিপি সদস্যদের অস্ত্র সজ্জিত করার লক্ষ্যে অস্ত্র ক্রয় সংক্রান্ত সাম্প্রতিক সরকারি সিদ্ধান্তে অনেকে আসন্ন সংঘাত-সংঘর্ষের আশংকাও করছেন। সহিংস আন্দোলন কারুরই কাম্য নয়। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে যখন সরকার বাধা দিয়েছে, পুলিশ বাহিনী ও দলীয় ক্যাডার দিয়ে দমনের চেষ্টা করেছে তখনই আন্দোলনকারীরা আত্মরক্ষার জন্য উগ্রতা প্রকাশ করেছে বা সহিংস হয়ে উঠেছে। সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল গণতান্ত্রিক অধিকার। আমাদের দেশে এগুলো নিষিদ্ধ হলো কবে? গণসংযোগ, মানববন্ধন, পথসভা এমনকি ঘরোয়া বৈঠক থেকেও রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার করা হবে কেন? সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র বা নাশকতা সৃষ্টি ছাড়া কি মানুষের আর কোন কাজ নেই? রাজনৈতিক দলগুলোকে এতো ছোট করে না দেখলে কি নয়? আওয়ামী লীগ আমাদের দেশ থেকে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যেমনি উচ্ছেদ করেছে তেমনি চিরায়ত কিছু প্রথাকেও তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। পাবলিক মিটিং-এর নির্দিষ্ট ভেন্যু এখন নেই। মাইকিং পাবলিসিট নেই। গণতন্ত্র সরকারের হাতের মুঠোয় বন্দী। রক্ষক এখন ভক্ষক। এই অবস্থার পরিবর্তনে সচেতন প্রত্যেকটি মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। ময়দান নিয়ন্ত্রণ কঠিন নয়, সরকারের পয়সা আছে অস্ত্র আছে। এর অপব্যবহার কল্যাণকর হয় না। জনস্রোতে সব ভেসে যায়।

http://www.dailysangram.com/post/345993