১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, সোমবার, ৯:৫৭

বেপরোয়া বীমা কোম্পানি

অডিট চালুর চেষ্টা চলছে -আইডিআরএ

বীমা খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আসছে না। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গ্রাহকের অর্থ ব্যয় করছে কোম্পানিগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লাখ লাখ বীমা গ্রহীতা। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে টানা এক বছর ৯ মাস বীমা কোম্পানির বিশেষ নিরীক্ষা (অডিট) বন্ধ রয়েছে।
একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী মন্ত্রণালয়কে প্রভাবিত করায় এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। তবে আইডিআরএ বলছে, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ব্যাপারে চেষ্টা চলছে।

জানতে চাইলে আইডিআরের সদস্য গকুল চাঁদ দাস যুগান্তরকে বলেন, বিশেষ নিরীক্ষা চালুর ব্যাপারে মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই বিষয়টির সমাধান হবে। এরপর কোম্পানিগুলোয় নিরীক্ষা চালানো যাবে। তিনি বলেন, শুধু সাধারণ বীমার ক্ষেত্রে নিরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। জীবন বীমার ক্ষেত্রে বিশেষ নিরীক্ষায় আপত্তি নেই।

জানা গেছে, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গ্রাহকের টাকা বেপরোয়াভাবে ব্যয় করছে বীমা কোম্পানিগুলো। ২০১৬ সালে আটটি বীমা কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যয় অনুসন্ধানে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। কোম্পানিগুলো হল- গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, পিপলস ইন্স্যুরেন্স, এক্সপ্রেস, কনটিনেন্টাল, ফিনিক্স, প্রগতি, ফেডারেল, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশ ও ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স।
কোম্পানিগুলোর তিন বছরের আর্থিক হিসাব নিরীক্ষা করার কথা। এর মধ্যে রয়েছে কোম্পানির বিনিয়োগ, ঋণ, অগ্রিম, স্থায়ী সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদ, গাড়ি, জমি ও বিল্ডিং, নগদ টাকা, ট্যাক্স ও ভ্যাট এবং চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা কী পরিমাণ বেতন-ভাতা ও অন্য সুবিধা নিয়েছেন তার তথ্য।
আইডিআরএ’র বক্তব্য হল- কোম্পানিগুলো ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ক্ষেত্রে বীমা আইন ২০১০-এর ৬৩ ধারা লঙ্ঘন করছে। ১৯৫৮ সালের বীমাবিধি অনুসরণ করলেও ৪৩ ধারা যথাযথভাবে তারা মানছে না। দেশের বীমা খাতের একটি প্রভাবশালী গ্রুপ নিরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে। আইডিআরএ’র এই বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এখন পর্যন্ত ওই নির্দেশনা বহাল রয়েছে।

নিয়ম অনুসারে সাধারণ বীমা খাতের কোম্পানিগুলো থেকে গ্রাহকরা তিন ধরনের বীমা পলিসি গ্রহণ করে। এর মধ্যে রয়েছে নৌ-বীমা, অগ্নিবীমা ও মটর (গাড়ি) বীমা। ১৯৫৮ সালের বীমাবিধির ৪০ ধারায় সাধারণ বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
ওই নির্দেশনা অনুসারে কোম্পানিগুলো নৌ-বীমার ক্ষেত্রে মোট প্রিমিয়াম আয় থেকে প্রথম এক কোটি টাকায় ১৮ শতাংশ অর্থাৎ ১৮ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় এক কোটিতে ১৫ শতাংশ, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ এক কোটিতে ১৩ শতাংশ ব্যয় করতে পারে।
এছাড়া সপ্তম এক কোটিতে ১১ শতাংশ এবং এর পরবর্তী মোট প্রিমিয়ামের জন্য ১০ শতাংশ হারে ব্যবস্থাপনা ব্যয় করতে পারে। অর্থাৎ নৌ-বীমায় কোনো কোম্পানির আট কোটি প্রিমিয়াম আয় হলে কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খাতে এক কোটি আট লাখ টাকা ব্যয় করতে পারে। এছাড়া অগ্নি ও অন্য বীমার ক্ষেত্রে প্রথম এক কোটিতে ৩০ শতাংশ, দ্বিতীয় এক কোটিতে ২৫ শতাংশ, তৃতীয় ও চতুর্থ এক কোটিতে ২৪ শতাংশ, পঞ্চম এক কোটিতে ২৩ শতাংশ, ষষ্ঠ এক কোটিতে ২২ শতাংশ, এর পরের এক কোটি ২৫ লাখে ১৮ শতাংশ এবং এর পরবর্তী মোট প্রিমিয়ামের জন্য ১৬ শতাংশ হারে ব্যবস্থাপনা ব্যয় করতে পারবে।

আইডিআরএ’র নিয়োগ করা অডিট কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে- গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সে মেসার্স নুরুল ফারুক হাসান অ্যান্ড কোং, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সে একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস, কনটিনেন্টালে মেসার্স হাওলাদার ইউনুস অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস, ফিনিক্সে মসিহ মুহিত হক অ্যান্ড কোম্পানি, প্রগতিতে হুদাভাসি চৌধুরী, ফেডারেলে এমজে আবেদিন অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশ বিডিও এবং ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সে এসএফ আহমেদ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
অন্যদিকে আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ১৬টি জীবন বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি আইডিআরএ চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আইনে উল্লিখিত সীমার চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স ২৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।

এছাড়া সান লাইফ ৮৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা, পদ্মা লাইফ ১৬৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, প্রগতি লাইফ ১৪৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, সানফ্লাওয়ার লাইফ ৮৬ কোটি ১৮ লাখ, মেঘনা লাইফ ৮৩ কোটি ৯৪ লাখ, ন্যাশনাল লাইফ ২১ কোটি ৩৭ লাখ, গোল্ডেন লাইফ ১৫৬ কোটি ২৫ লাখ, বায়রা লাইফ ৩৮ কোটি ৬৫ লাখ, সন্ধানী লাইফ ১৫৫ কোটি ৫৯ লাখ, প্রগ্রেসিভ লাইফ ৩৯ কোটি ৪৪ লাখ, হোমল্যান্ড লাইফ ৪৬ কোটি ৯৫ লাখ, প্রাইম ইসলামী লাইফ ৭১ কোটি ৭৯ লাখ, ফারইস্ট লাইফ ২০০ কোটি ৫১ লাখ, রূপালী লাইফ ৪৪ কোটি ৪০ লাখ এবং ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ৫৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন থেকে অবহেলিত বীমা খাত। এরপর দেশের অর্থনীতির আকার অনুসারে বীমা কোম্পানির সংখ্যা বেশি। বর্তমানে ৭৮টি বীমা কোম্পানি কাজ করছে। ফলে কোম্পানিগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা রয়েছে। এছাড়া এ খাতে দক্ষ জনবলের খুবই সংকট। সবকিছু মিলে এ খাত বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে।

এ অবস্থায় এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে আইডিআরএ। বীমাবিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও রাজধানীতে কেন্দ্রীয়ভাবে মেলা করেছে আইডিআরএ।
এছাড়াও বীমা শিল্পের দাবি নিষ্পত্তিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির নির্দেশনা অনুসারে বীমা দাবির জন্য গণশুনানির বিজ্ঞাপন পত্রিকায় দেয়া। বীমা নীতিমালা ২০১৪ বাস্তবায়নে বিভিন্ন কমিটি কাজ করছে।
মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন রোধে বীমাকারী গ্রাহকের কেওয়াইসি চালু করা হয়েছে। বীমার বহুমুখীকরণের জন্য সরকারের প্রস্তাব অনুসারে শিক্ষা বীমা, পেনশন বীমা, কৃষি বীমা, পশুসম্পদ বীমা, প্রবাসী বীমা, বেকারত্ব বীমা, স্বাস্থ্য বীমা এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের বীমার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। তবে বীমা খাতের প্রভাবশালীদের কারণে পদে পদে বাধা পাচ্ছে সংস্থাটি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/91190