১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, সোমবার, ৯:৪৯

বিদ্যুৎ বিলের নির্যাতন

আশিকুল হামিদ : রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় যেখানে বসবাস করি সেখানে দিন কয়েক আগে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে হঠাৎ বহু মানুষের জটলা দেখে এগিয়ে না গিয়ে পারলাম না। জটলার কারণ বিদ্যুতের বিল। না, তাই বলে বিল কম আসেনি। আওয়ামী লীগ সরকার যেহেতু ক্ষমতায় রয়েছে সেহেতু তেমন আশাও কেউ করেন না। করেননিও। কিন্তু ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড বা ডিপিডিসি নামের প্রতিষ্ঠানটি আগস্ট মাসের যে বিল ওই অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসকারীদের নামে পাঠিয়েছে সেগুলোর প্রতিটিতেই টাকার পরিমাণ অনেক বেশি। কারো কারো নামে আগের মাস জুলাইয়ের তুলনায় বিল এসেছে দ্বিগুণেরও বেশি। এরকম একজন জানালেন, জুলাই মাসে তার বিল যেখানে তিন হাজার আটশ টাকার মতো এসেছিল সেখানে আগস্টে এসেছে নয় হাজার ২৯২ টাকা। প্রায় তিন গুণ বেশি। এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের মালিক ও ভাড়াটেদের পক্ষ থেকে ডিপিডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এর লোকজন এসে সব মিটার ‘চেক’ করে দেখিয়েছে। বলেছে, ‘ডিজিটাল’ মিটারে জালিয়াতি বা কারসাজি করার এবং ‘ভূতুড়ে’ বিল বানানোর সুযোগ নেই। নয় হাজার ২৯২ টাকার বিল পেয়ে যার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা ডিপিডিসির লোকজন তাকে বলেছে, তিনি নিশ্চয়ই এসি ব্যবহার করেন। এসি ব্যবহারের কথা স্বীকার করে ওই ভদ্রলোক বলেছেন, এসি তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে ব্যবহার করছেন। তাছাড়া আগস্টের তুলনায় জুন-জুলাই মাসে গরম অনেক বেশি ছিল। ওই দু’মাসে এসিও বেশি চালানো হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিল এসেছে চার হাজার টাকার কম। শুধু তা-ই নয়, পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে দিন পাঁচেক তারা বাসাতেই ছিলেন না। অর্থাৎ অন্তত পাঁচদিন তারা এসি দূরে থাকুক, বিদ্যুৎই ব্যবহার করেননি। তবুও বিল কেন তিন হাজার আটশ টাকার স্থলে চার-পাঁচ, এমনকি ছয় হাজারও নয়Ñ এক লাফে নয় হাজার টাকার ওপরে চলে গেছে?

এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর ডিপিডিসির লোকজন দিতে পারেনি। আমতা আমতা করে তারা নাকি শুধু বলেছে, ‘ডিজিটাল’ মিটারে জালিয়াতি বা কারসাজি করার সুযোগ নেই। কিছু একটা কারণ নিশ্চয়ই ঘটেছে। কিন্তু কারণটি কি বা কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেনি ডিপিডিসির লোকজন। অথবা পারলেও জানায়নি তারা। শুধু বলে গেছে, বিল যেন নির্ধারিত তারিখের মধ্যেই পরিশোধ করা হয়। না হলে লাইন বা সংযোগ কেটে দেয়া হবে।
এটা রাজধানীর একটি এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ঘটনা। সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে এভাবেই গ্রাহকদের বর্ধিত হারে এবং অবিশ্বাস্য পরিমাণে বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাব-এর দেয়া পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনÑ বিইআরসি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ৩৫ পয়সা হারে দাম বাড়ানোয় গ্রাহকদের ব্যয় বেড়ে গেছে ১৩ হাজার ২২ কোটি টাকা। শতকরা হিসেবে দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। এর শুরু হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে। এই বৃদ্ধি অবশ্যই অস্বাভাবিক এবং জনগণের ওপর প্রচন্ড নির্যাতন চাপানোর শামিল।

স্মরণ করা দরকার, গত বছরের নভেম্বরে নেয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ক্যাব-এর পক্ষ থেকে দাম কমানোর দাবি জানিয়ে বলা হয়েছিল, বিল না কমালে বিইআরসির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে অন্য রকম। বিইআরসি যেমন এক পয়সাও দাম কমায়নি, ক্যাবও তেমনি কোনো মামলা দায়েরের ধারে কাছে যায়নি। অন্তরালে কোনো বিশেষ আয়োজন রয়েছে কি না সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সন্দেহ নেই। তবে কথায় কিন্তু ক্যাব নেতারা সব সময়ই এগিয়ে থেকেছেন। এখনো তারা এগিয়েই রয়েছেন- যদিও এই ক্যাব-এর মাধ্যমে গ্রাহকরা কখনো উপকৃত হয়েছেন বলে জানা যায় না।
ক্যাব কিভাবে ‘জনস্বার্থে’ ভূমিকা পালন করে- সে বিষয়ে উদাহরণ দেয়ার জন্য গত নভেম্বরের কথা উল্লেখ করা যায়। সেবার বিইআরসির উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত গণশুনানির কথা উল্লেখ করে ক্যাব নেতারা বলেছিলেন, প্রতিটি গণশুনানিতেই তথ্য-পরিসংখ্যানসহ তারা এই মর্মে প্রমাণ হাজির করেছেন যে, কথিত লোকসান কমানোর জন্য মূল্যবৃদ্ধি করার কোনো যুক্তি নেই। দরকার বরং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং সিস্টেম লস ধরনের প্রতারণার অবসান ঘটানো। ক্যাব নেতৃবৃন্দসহ গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা আরো বলেছিলেন, রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল ধরনের বিদ্যুতের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়ার কর্মকান্ডের কারণেও বিইআরসির লোকসানের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। এই লোকসানের দায় কোনোক্রমেই গ্রাহকদের ওপর চাপানোর যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার কিছুদিন পরপর বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে চলেছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে আটবার। সর্বশেষ গত বছরও আবাসিকসহ বিভিন্ন খাতে ৫ থেকে ৭ দশমিক ২১ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছিল বিইআরসি। তখনও এমনভাবে বলা হয়েছিল যেন সেটাই শেষবার, আর কখনো দাম বাড়ানো হবে না!

অন্যদিকে গত বছরই কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প এবং বাণিজ্যিক শ্রেণীর গ্রাহকদের ওপর ইউনিটপ্রতি তিন টাকা ৮২ পয়সা বাড়িয়ে চার টাকা করা হয়েছিল। চলতি বছরে এসেও বিইআরসি দাম বাড়ানোর পদক্ষেপই নিয়েছে। একই কারণে প্রশ্ন উঠেছে, বিইআরসি একাই যদি সিদ্ধান্ত নেবে তাহলে কেন গণশুনানির নামে দফায় দফায় নাটকের আয়োজন করা? এমন প্রশ্নের কারণ, কোনো গণশুনানিতেই দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি হাজির করতে পারেনি সরকার তথা বিইআরসি। পরিবর্তে তথ্য-পরিসংখ্যানসহ দাম না বাড়ানোর পক্ষেই অভিমত প্রকাশিত হয়েছে। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই ক্যাব-এর পক্ষ থেকে বিইআরসির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। ক্যাব এ জন্য ১০ দিনের সময়সীমাও বেঁধে দিয়ে বলেছিল, এর মধ্যে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাতিল না করা হলে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে ক্যাব আদালতের আশ্রয় নেবে। কিন্তু আগেই জানানো হয়েছে, জনগণের কথা বললেও ক্যাব ‘জনস্বার্থে’ তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

পাঠকদের মনে পড়তে পারে, সে সময় আমরাও হঠাৎ করে প্রতি ইউনিটের জন্য ৩৫ পয়সা হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলাম এবং ক্যাব-এর বক্তব্যের প্রতি সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়েছিলাম। এর একটি কারণ, সরকারের পক্ষ থেকে অনেক উপলক্ষেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ‘রেকর্ড’ সৃষ্টি করার দাবি জানানো হয়েছে। সরকার একই সঙ্গে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ থেকেছে। অন্যদিকে সংযোগ না পাওয়ার এবং বিশেষ করে গরমের সময় সীমাছাড়ানো লোডশেডিং-এর মতো তথ্যগুলো কিন্তু প্রমাণ করে না যে, সরকারের দাবি সত্যের ধারেকাছেও যেতে পেরেছে। তাছাড়া পর্যায়ক্রমে সরকার বিদ্যুতের দামও যথেষ্টই বাড়িয়েছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের খাতে বছরে ২২ থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়ার দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানোর ফলে গ্রাহকদের আটশ-এক হাজার টাকার স্থলে আড়াই-তিন হাজার, এমনকি চার-সাড়ে চার হাজার টাকা পর্যন্তও বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। সর্বশেষ আগস্টের ক্ষেত্রে তো প্রায় তিনগুণ পর্যন্ত বিল বেড়ে গেছে। কিন্তু এত কিছুর পরও বিদ্যুৎ সংকট থেকে রেহাই মেলেনি, বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়ার জন্যও মানুষকে বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। অনেক শিল্প-কারখানা শুধু বিদ্যুতের সংযোগ না পাওয়ার কারণে চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। ওদিকে আবার লোডশেডিং-এর কারণেও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক শিল্প-কারখানা। এসবের সঙ্গে নিয়মিতভাবে যুক্ত হচ্ছে মানুষের কষ্ট। বিশেষ করে গরমের সময় লোডশেডিং-এর যন্ত্রণা মানুষকে দিশেহারা করে ফেলছে। পানির কষ্টও সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
এমন অবস্থা অবশ্যই চলতে পারে না। কারণ, বিদ্যুতের সঙ্গে শিল্পের উৎপাদন থেকে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া পর্যন্ত প্রতিটি বিষয় জড়িত। প্রসঙ্গক্রমে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও যে সময়ে সময়ে হাজার হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর গালগল্প শুনিয়ে থাকেন সে বিদ্যুৎ তাহলে যাচ্ছে কোথায়? পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বাস্তবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের নামে দলীয় লোকজনকে ব্যবসা পাইয়ে দেয়ার এবং তাদের পকেট ভারি করার ব্যবস্থাই শুধু করা হয়েছে। কারণ, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেখানে ব্যয় হয় দেড় থেকে দুই টাকার মতো সেখানে তেলভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের ব্যয় ১৪ থেকে ১৬ টাকা। এজন্যই একদিকে সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে চলেছে অন্যদিকে দলীয় লোকজনকে বছরে ভর্তুকি দিচ্ছে ২৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়ার পরও সংকটের সমাধান হচ্ছে না। কারণ, বাতিল ও পরিত্যাক্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে স্থাপন করার ফলে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো চাহিদা বা চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ করতে সক্ষম হচ্ছে না।
সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই বলা হচ্ছে, দলীয় লোকজনের পকেট ভারি করার জন্য বিপুল অর্থের অপব্যয় করার পরিবর্তে সরকারের উচিত জনগণের কষ্ট ও ভোগান্তিকে প্রাধান্য দেয়া এবং রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সম্পাদিত অসম চুক্তি বাতিল করা। সরকারকে একই সঙ্গে গ্যাসভিত্তিক প্রচলিত কেন্দ্রগুলোকে সংস্কার করে সেগুলোর মাধ্যমে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। নাহলে মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তি তো বাড়বেই, শিল্পায়নের সঙ্গে সামগ্রিক সমৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হবে। সৃষ্টি হবে না নতুন নতুন চাকরির সুযোগও। এজন্যই কথায় কথায় এবং যখন-তখন দাম বাড়ানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত বিদ্যুতের ব্যাপারে বাস্তবসম্মত ও সম্ভাবনাময় পথে অগ্রসর হওয়া, যাতে তিন হাজার টাকার বিল হঠাৎ করে নয় হাজার টাকারও বেশি না হয় এবং যাতে বিল দিতে গিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস না ওঠে।

http://www.dailysangram.com/post/345847