১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৩৫

হৃদরোগ চিকিৎসায় সংকট

দেশের হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে। প্রধান কয়েকটি হাসপাতালে হৃদরোগ চিকিৎসা ব্যাহত হওয়ায় রোগীরা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন। বাড়ছে তাদের মৃত্যুঝুঁকিও। সরকারি কয়েকটি প্রধান হাসপাতালে এই চিকিৎসা মুখ থুবড়ে পড়ার কারণে দালালরা বেসরকারি হাসপাতালে রোগী বাগিয়ে নিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

দেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হৃদরোগ বিভাগের প্রায় সবগুলো ক্যাথল্যাব মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ফলে সেখানে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টি। অন্যদিকে হৃদরোগ চিকিৎসার বিশেষায়িত একমাত্র সরকারি হাসপাতাল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার সংস্কারের দোহাই দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য রোগীরা মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে গেলেও শয্যা সংকটের কারণ দেখিয়ে তাদের ফিরেয়ে দেয়া হচ্ছে।

বিএসএমএমইউ কার্ডিওলজি বিভাগের তিনটি ক্যাথল্যাব মেশিনের তিনটিই প্রায় নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
এরমধ্যে বয়স্কদের জন্য দু’টি মেশিনের একটি প্রায় দু’বছর ধরে নষ্ট। অন্যটিও প্রায় ৬ মাস ধরে নষ্ট। ইতিপূর্বে দু’বার মেরামত করা হলেও এগুলো দিয়ে বেশিদিন কাজ চালানো সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে শিশুদের জন্য নির্ধারিত পেডিয়াট্রিক ক্যাথল্যাবটিও বেশ কিছুদিন ধরে নষ্ট। এ মেশিনটি ঠিক করতে কোটি টাকা প্রয়োজন। তবে মেশিনটির ওয়ারেন্টি পিরিয়ডও প্রায় শেষ। এ কারণে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সব ধরনের এনজিওগ্রাম ও এনজিও প্লাস্টি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছেন। ফলে রোগীদের অনেকে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন হৃদরোগ হাসপাতাল বা বেসরকারি হাসপাতালে।

বিএসএমএমইউ’র অধ্যাপক (চেয়ারম্যান, শিশু কার্ডিওলজি) ডা. মো. জাহিদ হোসেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে মানবজমিনকে বলেন, আমরা উৎকণ্ঠার মধ্যে আছি। অ্যাডাল্ট মেশিন দু’টি নষ্ট থাকায় দীর্ঘদিন ধরে এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টি হচ্ছে না। মেশিন দু’টি অনেক পুরনো হয়ে যাওয়ায় মেরামত করেও কাজ চালানো যাচ্ছে না। নতুন ক্যাথল্যাব মেশিন না আসা পর্যন্ত চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে না। পেডিয়াট্রিক ক্যাথল্যাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ মেশিনটির মেয়াদকাল আগামী ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এমন সময় মেশিনটির এক্স-রে টিউব নষ্ট হয়ে গেছে। এ টিউবটি ঠিক করতে প্রায় এক কোটি টাকা প্রয়োজন।

এটি সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে নতুন মেশিন আনা দরকার। তিনি বলেন, ক্যাথল্যাব চালু থাকলে গড়ে ১০টি এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টি করা সম্ভব। অ্যাডাল্ট মেশিন দু’টিতে করা যায় গড়ে ২০ থেকে ২৫টি। এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসএমএমইউ’র কার্ডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আলী আহসান মানবজমিনকে বলেন, মেশিনগুলো খারাপ ছিল। একটি মেশিন দিয়ে এতদিন ধরে কাজ করছি। কোটেশন পদ্ধতিতে মেশিন আনা সমস্যা। মেশিন আগামী এক সপ্তাহ লাগবে ঠিক হতে।

সূত্র জানায়, সরকারি হাসপাতালে এনজিওগ্রাম করতে খরচ পড়ে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা। হত দরিদ্র রোগীরা এটা মাত্র ৫শ’ টাকায় করতে পারেন। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে খরচ পড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। আর এনজিওপ্লাস্টি সরকারি হাসপাপাতালে ৬২ হাজার থেকে এক লাখ টাকায় চিকিৎসা খরচ হয়। বেসরকারি হাসপাতালে দেড় লাখ টাকা খরচ পড়ে। হৃদরোগে আক্রান্ত হানিফ মিয়া (ছদ্মনাম)।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এনজিওগ্রাম করতে চেয়েছিলেন। একদিন আগে তিনি হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেননি হাসপাতালটির অপারেশন থিয়েটার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। তিনি আর্থিকভাবে সচ্ছল না হওয়ায় বেসরকারি হাসপাতালে এনজিওগ্রাম করাতে পারছেন না। কতদিন পরে আবার চালু হবে তাও বলছে না কেউ। রাজধানীর আজিমপুরের এই বাসিন্দা তার জীবন নিয়ে এখন উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন ।

এদিকে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, দু’-তিন ধরে ওই প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে আসা কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে না। কারণ হাসপাতালের অপারেশর থিয়েটারে সংস্কার কাজ চলছে। তবে এ অবস্থা কতদিন থাকবে সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারছেন না তারা। যেসব রোগীর জটিল (শিশু ও প্রাপ্ত বয়স্ক) ভাসকুলার সার্জারি, বাইপাস সার্জারি, সিএপিজি, বাল্ব প্রতিস্থাপন বা চিকিৎসার প্রয়োজন তাদের ফিরে যেতে হচ্ছে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব রোগী দ্রুত উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে মৃত্যু ঝুঁকি থাকে। জানা গেছে, শুধু ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের ক্যাজুয়ালিটি ওটি চালু রয়েছে। যেখানে পায়ের শিরার অপারেশন ছাড়া আর তেমন কোনো কাজ করা হচ্ছে না। হৃদরোগ হাসপাতালে ৫টি অপারেশন থিয়েটার বা ওটি রয়েছে। এরমধ্যে প্রতিদিন অন্তত তিনটি ওটিতে কাজ চলে। এসব ওটিতে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫টি ওপেন হার্ট সার্জারি হয়ে থাকে।

কিন্তু ওটি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানোর এসব জটিল অস্ত্রোপচার স্থগিত থাকছে। এতে করে বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতালটিতে জীবাণু সংক্রামকের অভিযোগও উঠেছে। এ বিষয়ে জানতে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আফজালুর রহমানের সঙ্গে মোবাইলে কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা দিলেও উত্তর দেননি।

অন্যদিকে হৃদরোগ চিকিৎসায় অপর প্রতিষ্ঠান মিরপুর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন। চাদিহার তুলায় এখানেও শয্যার সংকট রয়েছে। ফলে এই হাসপাতালে ভর্তি হতে গিয়েও রোগী ফিরে আসতে হচ্ছে। হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহাজাদী ডলি বলেন, হাসপাতালে সিট মাত্র ৩৩০টি। কিন্তু চাহিদা বেশি। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

সিসিইউতে মাত্র ১৬টি শয্যা। সুতরাং অনেক সময়ে রোগীকে এখানে রাখা যায় না, অন্যত্র রেফার করতে হয়। আইসিইউতে সংক্রমণের কারণে রোগীদের হৃদরোগ হাসপাতালে রেফার করা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি এমন নয়। আইসিইউতে সিট কম থাকায় ওখানে রেফার করা হয়।

 

http://mzamin.com/article.php?mzamin=135492