১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:২৯

রেলের ৭০ ইঞ্জিন কিনতে ব্যয় বাড়বে ৭০০ কোটি টাকা

ঠিকাদার নির্বাচনেই সাত বছর পার ; প্রতি ইঞ্জিনের মূল্য ১৮ কোটি থেকে সাড়ে ২৭ কোটি টাকা

বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ৭০টি ইঞ্জিন কিনতে ব্যয় বাড়ছে ৭ শ’ কোটি টাকার বেশি। সাত বছর পার হয়েছে ঠিকাদার ঠিক করতে। এই সাত বছরে রেলওয়ের ৭০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ কেনার এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। এখন জনগুরুত্বপূর্ণ এই ইঞ্জিন কেনার প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে ১৩ বছর। আর এই অকারণ দেরির জন্য এখন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৭০৯ কোটি টাকা। সময়ক্ষেপণে প্রতিটি লোকোমোটিভের দাম ১৮ কোটি টাকা থেকে ২৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় দাঁড়াচ্ছে বলে রেলের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে।

রেল বিভাগ থেকে পাঠানো প্রস্তাবনার তথ্যানুযায়ী, রেলের বেশির ভাগ লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল অনেক আগেই অতিক্রম করেছে। এখন নতুন করে ৭০টি ইঞ্জিন কেনার জন্য এক হাজার ৯৪৫ কোটি ৮৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালের আগস্টে একনেকে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। ৬ বছরে ৭০টি ইঞ্জিন সংগ্রহ করার কথা ছিল। তখন শর্ত দেয়া হয় সরবরাহ ঋণে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু অনুমোদনের পরের মাসেই দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে কোনো রেসপনসিভ দরদাতা পাওয়া যায়নি। এর প্রায় দু’বছর পর ২০১৩ সালের জুলাই মাসে দ্বিতীয় বারের মতো দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেখানেও কারিগরিভাবে কোনো রেসপনসিভ দরদাতা পাওয়া যায়নি। এরপর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তৃতীয় বারের মতো দরপত্র আহ্বান করা হলে দু’টি দরপত্র পাওয়া যায়। স্পেনের মেসার্স ভোসস্লোহ স্পানা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মেসার্স হুনদাই রোটেম কোম্পানি দরপত্র দাখিল করে।

পরে মূল্যায়নে দেখা যায়, স্পেনের প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধিত নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। যার কারণে স্পেনের প্রতিষ্ঠানটির দরপত্র ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে (সিসিজিপি) গৃহীত হয়নি। দ্বিতীয় দরদাতার দরপত্র পুনঃমূল্যায়ন করা হয়। ২০১৮ সালের ১৬ মে পুনঃমূল্যায়ন প্রস্তাব অনুমোদন দেয় ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। আর সে কারণেই এখন প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশোধন আনা হয়েছে ৭ বছর পর। এখন এই প্রকল্পে জাইকা থেকে অনমনীয় ঋণসহায়তা পাওয়া যাবে। তারা ২ হাজার ৪৪ কোটি ৩৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করবে বলে প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
সাত বছরের অগ্রগতির তথ্যাদি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি হলো মাত্র ০.১৭ শতাংশ। অর্থাৎ সাত বছরে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। আর বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ০.৫০ শতাংশ। সময়ক্ষেপণের কারণে প্রতিটি লোকোমোটিভের মূল্য প্রায় ৫৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথমে ৭০টির জন্য ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ২৬০ কোটি টাকা। যেখানে দর পড়ে ১৮ কোটি টাকা। আর এখন বলা হচ্ছে, এই ব্যয় দাঁড়াবে এক হাজার ৯২২ কোটি টাকা। ফলে এখানে দর বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এখন প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এই সরবরাহ ঋণের প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য গত মে মাসে রেলওয়ের জন্য ১০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ ইঞ্জিন কেনার চুক্তি সই হয়েছে। ২৪ মাসের মধ্যে ১০টি ইঞ্জিন দেয়ার কথা।
সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় দু’দশক ধরে লোকোমটিভ, কোচ, ওয়াগন ক্রয়ের প্রকল্প নিয়েও বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীবাহী কোচ ও গাড়ির সঙ্কটের সমাধান হয়নি। মেরামতকৃত কোচের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও নতুন কোচ কেনার প্রকল্পও থেমে নেই। চলমান দশ প্রকল্পের মাধ্যমে মোট ১ হাজার ১৬০টি লোকোমটিভ, কোচ এবং ওয়াগন কেনার কথা। যার জন্য মোট অর্থ বরাদ্দ রয়েছে ৬ হাজার ৩ শ’ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলো ২০০৭ সালে এবং ২০১০ সালে শুরু হয়েছে। কিন্তু আজও ক্রয় প্রকল্পগুলো শেষ হচ্ছে না। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গত ছয় বছরে ৪৬টি লোকোমটিভ, ৫১৬টি ওয়াগন সংগ্রহ করা হয়েছে। আর যাত্রীবাহী কোচ মেরামত করা হয়েছে ২৬০টি বলে রেলওয়ের ওয়েবের তথ্যে বলা হয়েছে।

ডিপিপিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমানে ২৭৫টি লোকোমোটিভ রয়েছে। যার মধ্যে ১৮১টি এমজি বা মিটারগেজ এবং ৯৪টি হলো ব্রডগেজ বা বিজি। লোকোমোটিভের বা ইঞ্জিনের ইকোনমি লাইফ হলো ২০ বছর। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ের ১৪২টি ইঞ্জিনের এই লাইফ ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে। পুরাতন লোকোমোটিভের রক্ষণাবেক্ষণ যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি নির্ভরযোগ্যতা খুবই কম।

প্রকল্পের কার্যক্রমে বলা হয়েছে, ৭০টি ইঞ্জিন কেনা ছাড়াও এই প্রকল্পের মাধ্যমে পার্বতীপুরস্থ কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপের সুবিধাগুলোর উন্নয়ন করা হবে। লোকোমোটিভ অ্যাসেম্বলিং করার সক্ষমতা তৈরির জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। কিন্তু গত সাত বছরে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ০.৫০ শতাংশ। প্রকল্পে ৩০টি সম্পূর্ণ লোকোমোটিভ, ২৫টি সেমি নক-ডাউন কন্ডিশন লোকোমোটিভ এবং ১৫টি সম্পূর্ণ নক-ডাউন কন্ডিশন লোকোমোটিভ সংগ্রহ করা।
এ দিকে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বেশি দরে লোকোমোটিভ না কিনে সরকারি অর্থায়নেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সমীচীন হবে। এখানে উচ্চ মূল্যে দরদাতার অর্থায়ন গ্রহণ না করাই ভালো।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/348917