১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:২৭

বাংলাদেশে গুমের অধিকাংশ রাজনৈতিক কারণে

ডঃ মুহাম্মদ রেজাউল করিম : একজন মানুষ অসুস্থ হলে সুস্থ হওয়ার আশায় আপনজন বুকবাঁধে। কেউ মৃত্যুবরণ করলে মানুষ তার জন্য দোয়া করতে থাকে, মনকে চূড়ান্ত প্রবোধ বা সান্ত¦না দেয়া যায়। মৃত ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। কবর জিয়ারত করে মনকে অন্তত সান্ত¦নাটুকুন তো দেয়া যায়। কিন্তু “গুম” যেন সব বেদনা থেকে ব্যতিক্রম! গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার যেন কোনই শেষ নেই! নেই কোন সমাধান!! আপনজনকে ফিরে পাবার আশায় প্রহর গুনতে থাকে অবিরত আর অনন্ত সময়কাল ...। অন্ধকার অমানিশা ভেদ করে আর যেন রাত পোহায়না!!
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ এখন একটি গুমের স্বর্গরাজ্যের দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে পৃথিবীব্যাপী।
গত ৩০ আগস্ট বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক গুম দিবস পালন করা হয়েছে। গুম দিবস পালনের মাধ্যমে ভিকটিমদের প্রতি কিছুটা সাময়িক সহানুভূতি প্রদর্শন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। কিন্তু নির্যাতনকারীরা থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

মানবাধিকার চর্চার অভাবে গুমের মত অমানবিক একটি নির্যাতন পদ্ধতির জন্ম হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই চালু হয় গুম প্রথার। এর অধিকাংশই রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে হয়েছে।
পৃথিবীতে নিপীড়ক শ্রেণি সাধারণত নানাভাবে মানুষকে নির্যাতন করে আসছে অনাদিকাল থেকে। একসময় কার্য হাসিলের জন্য শারীরিক নির্যাতন, জরিমানা, বন্দী বা কারাদ-াদেশ কিংবা হত্যা করা হতো। কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে সেটি হল- “গুম”।
পৃথিবীর সকল আধুনিক সরকার ব্যবস্থায় মানুষের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় ও প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিকভাবে আইন প্রণীত হলেও কার্যত তা আজ প্রয়োগ করা হচ্ছে না। অথচ বিনা বিচারে মানুষকে গুম করে ফেলা হচ্ছে। অপরাধী কিংবা নিরপরাধী প্রমাণ করার থাকছে না কোন প্রকার সুযোগ। মাসের পর মাস বছরের পর বছর থাকতে হচ্ছে অন্ধকার প্রকোষ্টে। ভিকটিমের পরিবারের থাকছে না কোন প্রকার বিচার চাইবার ন্যূনতম পরিবেশ।

আপন বয়ে বেড়াচ্ছে এক অমানবিক, দুঃখ, কষ্ট বেদনা। সন্তান হারা বাবা-মায়ের গুমরে রাত জাগা ক্রন্দন, স্বামী হারা স্ত্রীর অব্যক্ত বেদনা, বাবা হারা সন্তানের অশ্রুসিদ্ধ নয়নের চাহনী আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হলেও এই অমানবিক কাজের হুকুম দাতা কিংবা সংশ্লিষ্টদের পাশান হৃদয় এতটুকু করুণা জাগ্রত হচ্ছে না।

বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন-২০০৯ সনের ৫৩ নং আইন অনুযায়ী “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং নিশ্চিতকরণ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য; সেহেতু মানবাধিকার সংরক্ষণ উন্নয়ন এবং মানবাধিকার যথাযথভাবে নিশ্চিত করবার উদ্দেশ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নামে একটি কমিশন প্রতিষ্ঠা করা।” প্রণীত আইনে মানবাধিকার কমিশন গঠন ও এর কার্যাবলিও ঠিক করে দেয়া আছে। ২০০৯ সালের পুনর্গঠিত মানবাধিকার কমিশন আইনে মানুষের অধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের কথা বলা থাকলেও বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষার বিপরীতে মানবাধিকার লংঙ্ঘনের প্রবণতা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লংঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম করার মাধ্যমে।

এসব ক্ষেত্রে সরকারী বাহিনী তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অধিকহারে জড়িত বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কখনো বা সাদা পোশাকে, কখনো বা ইউনিফর্ম পরিহিত বাহিনী এসব হত্যা বা গুমের সাথে জড়িত রয়েছে। আশংঙ্কার দিক হলো ভিকটিমের পরিবার নিখোঁজ স্বজনের বিষয়ে থানায় গিয়ে জিডি করতে পারে না। যা নিরাপত্তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও চরমভাবে মানবাধিকার লংঙ্ঘন দেশের নাগরিক হিসেবে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা এইচআরডব্লিউ মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশকে ব্যর্থ বলে আখ্যা দিয়েছে। সংস্থাটি ৯০ টিরও বেশি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন রিপোর্ট দেন।

বাংলাদেশে বিরোধী মতের রাজনৈতিক কর্মী কিংবা শত্রুতামূলকভাবে গুম করার মাধ্যমে মানবাধিকার লংঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসাবে বর্তমান সরকারের আমলে অর্থাৎ ২০০৯ থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত গুমের শিকার হয়েছেন প্রায় ৪৩২ জন নাগরিক। সংস্থাটির হিসেব অনুযায়ী নিখোঁজ হওয়াদের মধ্যে ফিরে এসেছে মাত্র ২৫০ জন। কিন্তু এখনো নিখোঁজদের ব্যাপারে কোন প্রকার তথ্য-উপাত্ত সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি। তবে গুম হওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী তথা বিএনপি-জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মী। যাদের অনেকে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। ২০১০ সালে গুম হন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম, ২০১২ সালে গুম হন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী, এখনো নিখোঁজ আছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর, অধ্যাপক গোলাম আযম-এর পুত্র সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল্লাহিল আমান আযমী, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর পুত্র ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাশিম, শিবির নেতা হাফেজ জাকির হোসাইন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা আল মোকাদ্দাস ও ওয়ালি উল্লাহসহ জামায়াত-শিবিরের শীর্ষ পর্যায়ের অসংখ্য নেতা-কর্মী। নিখোঁজ হওয়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিনকে ভারতের শিলিগুড়িতে পাওয়া যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পরবর্তীতে তাকে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সাজিয়ে পুলিশ আটক করে ভারতের কারাগারে বন্দি করে রেখেছে।

সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো গুমের তালিকায় এখন আর রাজনৈতিক কর্মী সীমাবদ্ধ নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, আইনজীবী, সাবেক রাষ্ট্রদূত এমনকি সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিরাও রয়েছে।
বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম পরিস্থিতির যে চরম অবনতি হয়েছে তা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ৩৯তম নিয়মিত অধিবেশন উপলক্ষে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কাছে পাঠানো এক রিপোর্টে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টার (এএলআরসি) ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ৪৩২ জন নাগরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক গুমের শিকার হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

লোকদের তুলে নেয়ার তালিকায় যে সকল এজেন্সীর নাম এসেছে সেগুলো হলোÑ ডিবি, পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমস ইউনিট(সিটিটিসিইউ), র্যা ব ও একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এএলআরসি আরো বলেছে, নাগরিকদের তুলে নেয়া ও গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ কোনভাবেই স্বীকার করছে না আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। যদিও গুম হওয়ার কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর অনেক নাগরিককে বন্দি অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো গুমের সাথে সংশ্লিষ্টতা স্বীকার না করলেও অনেক ক্ষেত্রে যে জড়িত তার প্রমাণ মিলেছে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার রায়ের মাধ্যমে। নারায়ণগঞ্জের ওই মামলায় বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়ার জামাতা র্যা বের কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত হন। এমতাবস্থায় গুমের সাথে প্রশাসনের লোক ও সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ থাকাটাও অস্বাভাবিক মনে হয় না। কেননা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে এক বক্তব্যে বলেছেন, গুমের ঘটনা এখনই প্রথম নয় সারা বিশ্বে হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের উদাহরণ টানেন। কিন্তু তাঁর এমন বক্তব্যে গুমের শিকার লোকদের ফিরে পাওয়া ও ভিকটিমের পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বাধাগ্রস্ত করবে বলে অনেকের ধারণা। যেহেতু গুম কোনভাবেই মানবাধিকার রক্ষা করে না সেহেতু এরূপ মন্তব্য কোনোভাবেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে না।

৩০ আগস্ট প্রথম আলো পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে গুম হওয়া ৫ জন ব্যক্তির পরিচয় গোপন করে তাদের অভিজ্ঞতার কথা ছেপেছে। এতে রোমহর্ষক সব ঘটনা তারা বর্ণনা করেছেন। গুম থাকাকালীন ব্যক্তিরা এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না। কেননা তাদের প্রত্যেককে মাসের পর মাস হাত পা ও চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয়েছিল। তাদের অনেকের চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সবসময় তাদেরকে এক অজানা আতঙ্ক গ্রাস করছে।

বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০১৭ অনুযায়ী কোথাও মানবাধিকার লংঘনের তথ্য বা অভিযোগ পেলে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার কথা থাকলেও এখন তা নীরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছেন।
বাংলাদেশে যে সকল গুমের ঘটনা ঘটছে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধের কারণে। তবে তা গণতন্ত্রের বিকাশ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কোনভাবেই মঙ্গলজনক নয়। মনে হচ্ছে বাংলাদেশ এখন গুমের একটি স্বর্গরাজ্য। যে দেশে গুমের সাথে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা সরাসরি জড়িত সেখানে জনগণকে জননিরাপত্তা কে দিবে?
লেখক : সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা।

http://www.dailysangram.com/post/345424