১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১০:২৫

ভূস্বামীরাও ভূমিহীন

হাতুড়ি, শাবল ও গাঁইতি চালিয়ে ভিটার ইট খুলছিলেন ওহাব আলী ও তার দুই সঙ্গী। পেশায় রাজমিস্ত্রি ওহাব মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় কিনেছেন কাশেম হাওলাদারের আধা-পাকা বসতবাড়ির ভিটায় ব্যবহূত ইট-পাটকেল। পূর্বনড়িয়া গ্রামের যেখানটায় কাশেমের বাড়ি, তার শিয়রে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলছে পদ্মা। বাড়িটি নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই বাড়ির মালিক প্রথমে টিন ও কাঠ খুলে নিয়ে গেছেন। এরপর ভিটাটি বিক্রি করে দিয়েছেন। ওহাব জানালেন, মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় কেনা এই বাড়িটি তৈরি করতে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হবে। ইট খুলে নেওয়ার বিনিময়ে বাড়ির মালিককে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিলেও সেগুলো খুলে নিয়ে যেতে ওহাবের হাজার বিশেক টাকা খরচ হচ্ছে। ওহাব বলেন, 'কিছু ইট হয়তো আনাম (আস্ত) বেচা যাবে। বাকিগুলান খোয়া বানিয়ে বেচব।'
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পদ্মাতীরের সর্বত্রই এমন ভাঙনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভূস্বামীদেরও ভূমিহীন করে দিয়ে পদ্মা তার কীর্তিনাশা নামটি সার্থক করেছে। পদ্মার আরেক নাম কীর্তিনাশা। অবশ্য শরীয়তপুর এলাকায় কীর্তিনাশা বলে পদ্মার একটি শাখা নদীর নামও রয়েছে। ১৯০৮ সালে প্রকাশিত 'ফরিদপুরের ইতিহাস' বইয়ে আনন্দনাথ রায় লিখেছেন, 'একমাত্র কীর্তিনাশার প্রাদুর্ভাবে সেই রমণীয় স্থান এখন শ্মশানে পরিণত হইয়াছে, অধিকাংশ বিল-ঝিল কীর্তিনাশার গর্ভস্থ হইয়াছে।'
পদ্মা এবারও অনেক কীর্তি নাশ করছে। রাজমিস্ত্রি ওহাব যেখানে কাশেম হাওলাদারের বাড়ির ইট খুলে নিচ্ছিলেন, তার লাগোয়া পশ্চিম পাশেই রয়েছে পৌরাণিক চরিত্র গাজী কালুর আস্তানা, যেখানে বছরে একবার ওরস হয়। সুন্দরবন অঞ্চলের গাজী কালু কেমন করে নড়িয়ায় এলো তার কোনো সদুত্তর এলাকাবাসীর কাছে নেই। তবে পদ্মার ভাঙনে নড়িয়ার সেই আস্তানাটিও টেকেনি। তিনতলা সুরম্য আস্তানাটির অতিথিশালা পুরোটাই নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছে। পাশেই এখনও চিহ্ন রয়েছে গাজী কালুর ভক্ত আবুল কালাম খানের বিলাসবহুল বাড়িটি। এর সদর দরজাতেই এখন পদ্মার ঘূর্ণিস্রোত। বাড়ির ভেতর থেকে এরই মধ্যে আসাবপত্র, ইট থেকে দরজা-জানালার কপাট খুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্দরমহলে গাজী কালুর নামে গড়ে তোলা আস্তানায় এখনও রয়ে গেছে তামার তৈরি বিশাল পাতিল। স্থানীয়ভাবে লোকজন সেটিকে বলেন, গাজী কালুর ডেক। ভক্তরা সেখানে তাদের মানতের টাকা ফেলেন মনের বাসনা পূরণে।

গতকাল শনিবার সকালের দিকে ধ্বংসপ্রায় গাজী কালুর আস্তানায় কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই ঢুকে দেখা গেল শত শত মানুষের ভিড়। ভক্তরা এখনও গাজী কালুর ডেকে তাদের মানত পূরণ করে চলছেন। কিন্তু এর পরিচালনাকারীদের কাউকেই সেখানে পাওয়া গেল না।

স্থানীয় লোকজন বলছিলেন, আস্তানা আর বিশাল অতিথিশালাটি নির্মাণ করেছিলেন গাজী কালুর ভক্ত আবুল কালাম খান। তিনিসহ পুরো পরিবারটিই আমেরিকা প্রবাসী। মাঝেমধ্যে সেখানে এসে থাকতেন। তবে সেই অট্টালিকাটি এখন নদীতে চলে যাচ্ছে।
নড়িয়া উপজেলার পদ্মাতীর সংলগ্ন ভাঙনকবলিত এলাকা ধরে হাঁটলে দেখা যাবে শুধু মানুষের হাহাকার। অনেক বিত্তশালী পরিবার এখন অসহায়। অট্টালিকা, ফসলভরা জমি, পুকুর ভরা মাছ হারিয়ে তারা এখন আশ্রয় নিয়েছেন স্বজনের বাড়িতে। কিন্তু নিজেদের আভিজাত্য ধরে রাখতে গিয়ে তারা যেন মুখও খুলতে পারছেন না।

এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জের দেওয়ান পরিবারটির পুরনো বনেদিপনা। বহু বছর আগে থেকেই বিত্ত-সম্পদে তাদের নাম-যশ রয়েছে। পদ্মার ভাঙনে পুরো পরিবারটি এখন প্রায় নিঃস্ব। ওই পরিবারের একজন সদস্য নুর হোসেন দেওয়ান। মুলফৎগঞ্জ বাজারে তিনি নড়িয়া উপজেলায় প্রথম বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপন করেছিলেন। একই এলাকায় স্ত্রী বেগম রওশন আরার নামে শপিং মল ও আধুনিক বিপণিবিতানও তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এবারের ভাঙনে তার এই সবই চলে গেছে পদ্মার গর্ভে। এর আগে ভাঙনের কবলে পড়ে নিজের বাড়িটির সঙ্গে জমিজমাও হারিয়েছেন। এক সময়ের বিত্তবান এখন আশ্রয় নিয়েছেন নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, যে কমপ্লেক্সের একটি অংশও এর মধ্যে ভেঙে গেছে।

জানা গেল, এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৬০ দশকে তৈরি করেছিলেন নুর হোসেন দেওয়ানের চাচা এক সময়ের এমএলএ আবদুল করিম দেওয়ান ওরফে মনাই দেওয়ান।
দেওয়ান পরিবারের আরেক সদস্য ইমাম হোসেন দেওয়ান। তিনি ভাঙনকবলিত কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন দীর্ঘদিন। এখন পদ্মার ডান তীর রক্ষার আন্দোলন করছেন। মুলফৎগঞ্জ বাজারেই কথা হলো তার সঙ্গে। তিনি জানালেন, নদী ভাঙনে গোটা পরিবারটির অসহায়ত্বের কথা।
ইমাম হোসেন দেওয়ান জানালেন, কেদারপুরের চর জুজিরা গ্রামে তিনি আদর্শ বাড়ি তৈরি করেছিলেন। মুলফৎগঞ্জ বাজারে তার বিশাল ব্যবসা ছিল। এর সবই এবার নদীতে চলে গেছে। গত কয়েক বছরে তাদের পরিবারের প্রায় ২০০ একর জমি, তাদের ভাইদের সবার বাড়ি, মুলফৎগঞ্জ বাজারে প্রায় ২০টি দোকানের সবই হারিয়ে গেছে নদীতে। সব মিলিয়ে গত কয়েক বছরে তাদের অন্তত দেড়শ' কোটি টাকার ক্ষতি হলো।

নদী ভাঙনে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কেদারপুর ইউনিয়নের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নড়িয়ায় পদ্মার তীর রক্ষায় হাজার কোটি টাকার যে প্রকল্প পাস করিয়েছিলেন, সময়মতো তার কাজ শুরু হলেও নড়িয়ার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। কেন সময়মতো কাজ শুরু হয়নি- সে প্রশ্নও তুললেন তিনি। জানালেন, প্রকল্প পাস হওয়ার পর পানি উন্নয়ন বোর্ড আর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপ করেছেন। পানিসম্পদমন্ত্রী বিষয়টিকে শুরুর দিকে একেবারেই পাত্তা দেননি। সময়মতো স্থানীয় সাংসদ কর্নেল (অব.) শওকত আলীও শক্তভাবে চেষ্টা করেননি। তারা উদ্যোগ নিলে নড়িয়ার মানুষের এমন বিপর্যয়ে পড়তে হতো না।

চেষ্টা করেও কথা বলা গেল না শরীয়তপুর-২ (নড়িয়া-সখিপুর) আসনের সাংসদ শওকত আলীর সঙ্গে। তবে পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সমকালের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো বিলম্ব হয়নি। ঠিক সময়েই কাজ শুরু হবে। এর মধ্যেই নৌবাহিনীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারা আগামী অক্টোবর-নভেম্বরে পদ্মার দক্ষিণ তীর রক্ষার কাজ শুরু করবে।

 

http://samakal.com/whole-country/article/1809922