১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১০:১৯

দিশেহারা মানুষ

বিপর্যয়ের মুখে নড়িয়া

মাদারীপুরে পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদী যেন রুদ্রমুর্তি ধারণ করেছে। এই দুই নদীর ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে তীরবর্তী এলাকার মানুষ। আতঙ্কে রয়েছে নিকটবর্তী আরও কয়েকশ পরিবার। ইতোমধ্যে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে অসংখ্য বসতভিটা-ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে নদীগর্ভে। অন্যদিকে, বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বৃহৎ জনপদ। সমাজের হতদরিদ্রদের পাশাপাশি স্বচ্ছল পরিবারগুলো তাদের শত বছরের আবাসস্থল হারিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে অন্যের জমি বা বাড়িতে। গত এক মাসে পদ্মা নদীর আগ্রাসী ছোঁবলে বিলীন হয়েছে ৬ হাজারেরও বেশী মানুষের বসত বাড়ি, ফসলি জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি ক্লিনিক, মসজিদ, মন্দির, পাকা সড়ক, বিদ্যুৎ লাইন, সামাজিক প্রতিষ্ঠানসহ মানুষের স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পদ।

নড়িয়া পৌর এলাকা, মোক্তারেরচর ইউনিয়ন ও কেদারপুর ইউনিয়নের প্রায় ১০ কিমি এলাকা হারিয়ে গেছে নদী গর্ভে। ফলে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে নড়িয়ার মানচিত্র। হাজার হাজার বাস্তহারা মানুষের মাথা গোজার ঠাঁই না হওয়ায় আর প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ঠিকমত দু‘বেলা খাদ্য আর চিকিৎসা সেবার সুযোগ না থাকায় গোটা এলাকা জুরে হাতছানি দিচ্ছে এক মানবিক বিপর্যয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়হীন মানুষদের জন্য কোন আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়নি।
এদিকে, দিন যতো যাচ্ছে পদ্মা ততোই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। পদ্মার সাথে অন্যান্য নদীর পানি বেড়ে ভাঙনের কবলে পড়ছে দেশের নতুন নতুন এলাকা। ইতোমধ্যে হাতিয়ায় মেঘনার ভাঙনে অব্যাহত তিন হাজার মিটার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মুন্সীগঞ্জে পদ্মা নদীর পান বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে পারে পদ্মা। রাজশাহী এবং বগুড়ায় নদ নদীতে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। নদী ভাঙনকবলিত এলাকাগুলো হাজার হাজার অসহায় মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ বরাদ্দ না দেয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে অসহায় মানুষ।
জানা গেছে, মাদারীপুরে নদী ভাঙনে শিবচর উপজেলার সন্যাসীরচর, চরজানাজাত, দত্তপাড়া, নিলখী ও বহেরাতলা ইউনিয়নে সাত শতাধিক ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়াও ভাঙনের শিকার হয়েছে দুটি বেড়িবাঁধ। ক্ষতিগ্রস্ত অসংখ্য পরিবার উঁচু সড়কসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। ভাঙ্গনের শিকার সন্নাসীর চর ৮নং ওর্য়াডের জামে মসজিদটি। ব্যক্তিগত ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।তবে প্রশাসন থেকে এদিকে আড়িয়াল খা নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে মাদারীপুর শহর শহরক্ষা বাঁধ এখন প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে রয়েছে। মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘুন্সি গ্রাম টি।

পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে উত্তর চরজানাজাত ইউনিয়নের প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেন্টারের দ্বিতল ভবন, একটি গুচ্ছগ্রামসহ ৫০টি ঘরবাড়ি। এ এলাকায় নদীতে বিলীন হয়েছে কমপক্ষে ৪শ একর ফসলি জমি। ভাঙনের আশঙ্কা রয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথ ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করে স্থানীয় সংসদ সদস্য নূর-ই-আলম চৌধুরী দুই লাখ টাকা ও পরিবার প্রতি ৩০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দিয়েছেন। তবে তা অপ্রতুল বলে দাবি করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরাা।
মানবিক বিপর্যয়ের মুখে নড়িয়া উপজেলা

এদিকে, ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পরেছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নড়িয়া পৌর এলাকা, মোক্তারেরচর ইউনিয়ন ও কেদারপুর ইউনিয়নের প্রায় ১০ কিমি এলাকা হারিয়ে গেছে নদী গর্ভে। ফলে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে নড়িয়ার মানচিত্র। হাজার হাজার বাস্তহারা মানুষের মাথা গোজার ঠাঁই না হওয়ায় আর প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ঠিকমত দু‘বেলা খাদ্য আর চিকিৎসা সেবার সুযোগ না থাকায় গোটা এলাকা জুরে হাতছানি দিচ্ছে এক মানবিক বিপর্যয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়হীন মানুষদের জন্য কোন আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়নি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে সব হারানোদের চরম দূর্দশার চিত্র, শোনা গেছে মানুষের গগণবিদারী বুক ফাঁটা আর্তনাদের করুণ শব্দ। কথা হলো, কেদারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ঈমাম হোসেন দেওয়ানের সাথে। আশ্রয় নিয়েছেন নড়িয়া পৌর এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তিনি ১৫ বছর ছিলেন এই ইউনিয়নের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। চাচা আব্দুল করিম দেওয়ান চেয়ারম্যান ছিলেন ৫০ বছর। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যও ছিলেন দীর্ঘদিন। ঈমান হোসেন দেওয়ানের ৫ একর জমি সমেত একটি সাঁজানো বসত বাড়ি ছিল। আরো ৫০ একর ছিল ফসলি জমি। বাড়িতে পাকা-সেমি পাকা ঘর ছিল অন্তত ১২টি।

মাত্র কয়েকদিন আগেও ঈমাম হোসেন দেওয়ানের সকাল শুরু হতো বৈঠক খানায় শত মানুষের কোলাহলের মাঝে। আজ সেই ঈমাম দেওয়ান নি:স্ব। আজ বাজারে তার বহুতল পাকা ভবন নেই, বাড়িতে সাঁজানো সাঁড়ি সাঁড়ি ঘর নেই। নেই দামী বিছানা-আসবাব। সব কিছুই কেড়ে নিছে রাক্ষুসী পদ্মা। তার বুক ফাঁটা কান্না শুনলে কোন সুস্থ্য মানুষ স্থির থাকতে পারেনা।

ঈমাম হোসেন দেওয়ান প্রলাপের সাথে বলছিলেন, “এখন আর কাঁদতেও পারিনা। চোখের সব পানি শুকিয়ে গেছে। আমরা হাজার হাজার মানুষ সব হারিয়েছি নদী গর্ভে। সরকার আমাদের রক্ষার জন্য হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিল, সময় মত প্রতিরক্ষা বাঁধ দিলে স্মরণ কালের এই ভয়ংকর ভাঙ্গনের শিকার আমরা হতামনা। আর কিছুই চাইনা, সরকার যেন এই এলাকাটিকে দূর্গত এলাকা ঘোষনা করেন, যেন মানুষের মাথা গোজার একটু আশ্রয় করে দেয়”। শুধু ঈমান হোসেনই নন, তার আপন ৫ ভাই, চাচাতো ভাই, বংশের অন্য সকলের অন্তত ২ শত একর জমি, বাজারের মার্কেট, বাড়ির পাকা বহুতল ভবন, ক্লিনিক সহ অন্তত শত কোটি টাকার সম্পদ বিলীন হয়েছে নদী ভাঙ্গনে।
উত্তর কেদারপুর জেলে পাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে আরেক করুণ চিত্র। ওই গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বিদের আবাস। বেশীরভাগ লোকই মৎসজীবী। গ্রামে ছিল শত বছরের পুরনো সত্য নারায়ন সেবা মন্দির। চোখের সামনেই বিলীন হলো শত ফুট উঁচু মন্দিরের মঠ সহ উপসনালয়ের সবগুলো চিহ্ন। এই মন্দিরের সভাপতি কার্ত্তিক চন্দ্র ঢালী ও তার স্ত্রী বীনা রানীর কান্নায় ভারী হয়ে উঠছিল বাতাস। তাদের আর্তনাদে সব কিছু যেন নিথর-স্থবির হয়ে যাচ্ছিল।

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে জরুরী প্রতিরক্ষার কাজ চলছে। ৭ কোটি ২০ লাখ টাকার ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। প্রয়োজনে আরো বরাদ্দ বাড়ানো হবে। নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানজিদা ইয়াছমিন বলেন, ইতোমধ্যে আমরা ৩ হাজার ৫ শত পরিবারকে ৩০ কেজি করে ত্রানের চাল বিতরণ করেছি। ২ বান্ডেল করে ঢেউ টিন বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ৭ শত পরিবারকে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নদী ভাঙনে ভিটে বাড়ি হারানো লোকদের কোন আশ্রয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, উপজেলায় ২৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে সেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয় নিতে জনপ্রতিনিধিদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

হুমকির মুখে চাঁদপুর শহর
বি এম হান্নান, চাঁদপুর থেকে জানান, বিশাল পানিরাশির চাপে হুমকির মুখে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধ। বারমুডা ট্রায়াঙ্গালের মতোই ভয়ঙ্কর রুদ্ররূপ ধারণ করছে প্রমত্তা পদ্ম-মেঘনা-ডাকাতিয়ার মিলনস্থল। শহর রক্ষা বাঁধের মোলহেডে নদীর গভীরতা ৭৫-৮০ মিটার অর্থাৎ ২৪০ফুট। স্রোতের গতিবেগ ঘন্টায় ৮-৯ নর্টিক্যাল মাইল। দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর প্রায় ৮০ভাগ পানি চাঁদপুর মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। এ কারণে চাঁদপুরের তিন নদীর প্রবাহমান পানিরাশিকে নদী বলতে নারাজ পানি বিশেষজ্ঞগন। তাদের স্বচ্ছ জবাব এটি নদী নয়, সাগর। ত্রিনদীর প্রবল পানি প্রবাহের সাথে ঘূর্ণিস্রোতে নদীর উত্তাল রুদ্ররূপ এখন ভয়ঙ্কর। পাউবোর চাঁদপুরে কর্মরত প্রকৌশলীদের মতে প্রতিদিনই উজানের পানির চাপ বাড়ছে। শহর রক্ষা বাঁধে বিপদ সীমার কাছ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ চাপ অব্যাহত থাকলে শেষ পযর্ন্ত কী হয় বলা যায় না। কোন কারনে শহর রক্ষা বাঁধের নতুনবাজার অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ২/৩ দিনের মধ্যে পুরো চাঁদপুর শহর ধংসলীলায় পরিণত হবে।

চলতি বর্ষা মৌসুমে কয়েকবার শহর রক্ষাবাঁধের পুরাণবাজার অংশে আঘাত করেছে মেঘনা। সর্বশেষ গত ৬ সেপ্টেম্বর কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে বাঁধের প্রায় ৬০ মিটার ব্লক নদীতে দেবে গেছে। মুহুর্তের মধ্যে সেখানে ভাঙ্গন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভাঙ্গন রোধে তাৎক্ষনিক কিছু বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলা হয়।
নদী ভাঙ্গনস্থল পরিদর্শন করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের পূর্বাঞ্চল কুমিল্লার প্রধান প্রকৌশলী বাবুল চন্দ্র শীল। ভাঙ্গন রোধে শহর রক্ষাবাঁধের পুরাণবাজার অংশের হরিসভা এলাকায় ২ হাজার ৮শ’ ৮০ বস্তা বালিভর্তি জিও ব্যাগ এবং ৬ হাজার ৬শ’ ১৫পিস সিসি ব্লক ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে পাউবো। এমনই তথ্য জানালেন শহর রক্ষা বাঁধের(পুরানবাজার) উপ-সহকারি প্রকৌশলী মো. আশ্রাফুরজ্জামান।
পাউবো সূত্র জানায়, চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের দৈর্ঘ্য ৩৩৬০মিটার। ১৯৭১ সাল থেকে ২০১০সাল পযর্ন্ত শহর রক্ষা বাঁধে ব্যয় হয়েছে ১শ’ ৬৫ কোটি টাকা। দীর্ঘ ৩৯ বছরে ঐ টাকা সরকার বরাদ্দ দেয়া বিভিন্ন কিস্তিতে। ফলে কাজটি অতোটা টেকসইজনক হয়নি।

শহর রক্ষা বাঁেধর(পুরানবাজার)উপ-সহকারি প্রকৌশলী মো. আশ্রাফুরজ্জামান জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারনেও নদী বিরূপ আচরণ করছে। তাছাড়া নদীর পাড় থেকে ৫শ’ মিটার দূরে ডুবোচর জেগে ওঠেছে। এ কারনে পানি স্বাভাবিক গতিতে ভাটিতে না যেয়ে কুল ঘেষে ওল্টো উজানের দিকে আসছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ঘূর্ণয় স্রোত।
পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান জানান, উজানের পানির চাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কী হয় বলা যায় না। এক কথায় শহর রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে।
হাতিয়ায় মেঘনার ভাঙ্গন অব্যাহত
নোয়াখালী ব্যুরো জানায়, হাতিয়া উপজেলার ছয় লক্ষাধিক অধিবাসীর দূর্ভোগ লাঘব হচ্ছেনা। ইতিমধ্যে হাতিয়া মূলভূখন্ড তৎসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে তিন হাজার মিটার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। হাতিয়াদ্বীপের ঐতিহ্যবাহী আফাজিয়া বাজার যেকোন মুহুর্তে নদীগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে। তেমনিভাবে উত্তরাঞ্চলের হরণী, চানন্দী ও জাহাজমারা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা ভাঙ্গনের শিকার। ইতোমধ্যে হরণী ইউনিয়নে ৬’শ মিটার, চানন্দী ইউনিয়নে ৯’শ মিটার, নলচিরা ইউনিয়নে ৮’শ মিটার এবং মোক্তারিয়া ঘাটে ৭’শ মিটার বিলীন হয়েছে। ভাঙন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় হাতিয়া মূলভূখন্ডের চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। দুই দশক পূর্বে নলচিরা ঘাট থেকে হাতিয়া উপজেলা ওছখালীর দূরত্ব ছিল ২০ কিলোমিটার। বর্তমানে নলচিরা ঘাট থেকে ওছখালীর দূরত্ব এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮ কিলোমিটার। অর্থাৎ ১২ কিলোমিটার এলাকা মেঘনায় তলিয়ে গেছে।

হাতিয়ার উত্তরাঞ্চল হরণী ও চানন্দী ইউনিয়নে ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জোয়ার সন্ধীপ ও হাতিয়া চ্যানেলের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য নদ নদীতে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জোয়ারের তীব্রতায় হাতিয়া, সন্ধীপ, রামগতি ও মনপুরা উপজেলা বিস্তীর্ণ এলাকা ভাঙ্গছে। নলচিরা, হরণী ও চানন্দী ইউনিয়নের দুই সহস্রাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এদের অনেকে বেড়ীবাঁধ কিংবা খোলা আকাশের নীচে আশ্রয় নিয়েছে।
অপরদিকে হাতিয়া নিঝুমদ্বীপের প্রবেশপথ জাহাজমারা মোক্তারিয়া ঘাটের পূর্বাংশে ভাঙ্গনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে মোক্তারিয়া ঘাট ও হরণী ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ বিলীন হয়েছে। আফাজিয়া বাজার নদীগর্ভে বিলীন হলে হাতিয়া মূলভূখন্ড চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। দুই দশক পূর্বে নলচিরা ও সুখচর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এখন নলচিরা ও সুখচর ইউনিয়ন দুইটি গ্রাম নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রয়েছে। হাতিয়া মূলভূখন্ডের চতুর্দিকে অসংখ্য ডুবোচর জেগে ওঠায় নদীর স্রোত পরিবর্তন হওয়ায় ভাঙ্গন বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাঙ্গনরোধ বিষয়ে জানতে চাইলে নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাছির উদ্দিন জানান, হাতিয়া মূল ভূখন্ড ও চারঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন হচ্ছে। ভাঙনরোধে প্রয়োজন স্থায়ী পরিকল্পনা। এক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সিডিএসপি যৌথভাবে ব্যাপক পরীক্ষা নীরিক্ষার মাধ্যমে মাধ্যমে প্রকল্প তৈরী করবে। পরে উক্ত প্রকল্প অনুমোদের জন্য সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন বিভাগে প্রেরণ করা হবে। এতে করে স্থায়ীভাবে হাতিয়া মূলভূখন্ড ও অন্যান্য চরাঞ্চল ভাঙনরোধ সম্ভব হবে।

রাজশাহীতে পদ্মার পানি বাড়ছেই
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহীতে পদ্মার পানি বাড়ছেই। প্রতিদিন তিন-চার সেন্টিমিটার করে বাড়তে বাড়তে বিপদসীমার কাছাকাছি চলে আসছে। শঙ্কা জাগাচ্ছে মানুষের মাঝে। গতকাল শনিবার দুপুরের পরিমাপে দেখা যায় পানির উচ্চতা ছিল ১৭ দশমিক ২৯ মি:। গত শুক্রবারের চেয়ে গতকাল পানি বৃদ্ধি হার সামান্য কিছু বেড়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়। এখানে বিপদসীমার মাত্রা হলো ১৮ দশমিক ৫০ মি:।
পদ্মায় অব্যাহতভাবে পানি বাড়তে থাকায় পদ্মা তীরবর্তী বিশেষ করে শহর রক্ষা বাঁধের দক্ষিণের নীচু এলাকার ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। নগরীর শ্রীরামপুর থেকে তালাইমারী পর্যন্ত নদী তীরবর্তী এলাকায় গড়ে ওঠা বস্তিতে মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে। পানি বাড়তে থাকায় বাঁধের নীচে বিনোদন পিয়াসীদের জন্য গড়ে তোলা স্পট গুলোয় পানি উঠেছে। নির্মানাধীন হাইটেক পার্কে গা ছুয়েছে পদ্মার পানি। লালনশাহ পার্ক, শিমলা পার্ক, পদ্মা গার্ডেন, বড়কুঠি, কুমারপাড়া, আরুপট্টি এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে।

গতকাল শহররক্ষা মূল গ্রোয়েন টি বাঁধে গিয়ে দেখা যায় সেখানে জিও ব্যাগে ভরে বালির বস্তা ফেলা আর পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বস্তায় বালি ভরে মজুদ করা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন রাজশাহীতে পদ্মা এখনো বিপদসীমার এক মিটারের বেশী নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তারা সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, একদিকে ফারাক্কার খোলা গেট দিয়ে পানি আসছে। আবার মহানন্দার ভারতীয় অংশে পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। ফারাক্কা আর মহানন্দার পানি এসে এপারের বন্যা অবস্থার সৃষ্টি করছে। এমনিতে পদ্মার তলদেশে ভরে গেছে আঠারো মিটার। ফলে ধারন ক্ষমতা দাড়িয়েছে পঞ্চাশ হাজার কিউসেক। এর অতিরিক্ত পানি সব ভাসিয়ে দেয়। শহররক্ষা বাঁধের নীচে পানি আসায় তারা সতর্ক রয়েছেন যাতে বাঁধ ভেঙ্গে শহরে পানি প্রবেশ করতে না পারে।

এদিকে নদীর ভাঙ্গন আর বন্যায় চরাঞ্চলের মানুষের দূর্ভোগ আরো বেড়েছে। গোদাগাড়ী থেকে বাঘা লালপুর পর্যন্ত উত্তর পাড় ভাঙছে। ওপারে দক্ষিন পাড়ের চরাঞ্চল চরআষাঢ়িয়াদহ, খিদিরপুর মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বগুড়ায় নদ নদীতে পানিবৃদ্ধি
বগুড়া ব্যুরো জানায়, ভারতীয় পানির ঢলে বগুড়ার যমুনা , বাঙালী ও করতোয়া নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বগুড়ার সারিয়াকন্দি পয়েন্টে ইতোমধ্যেই যমুনার পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ শনিবার দুপুরে জানিয়েছেন , আগামী ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলের নদনদী গুলোতে পানির প্রবাহ বাড়তির দিকে থাকবে । তবে ১৮ তারিখ পানি প্রবাহের হার বৃদ্ধির গতি স্লোথ হতে থাকবে । এই সময়ে এই এলাকায় অতি বৃষ্টি না হলে নদী ভাঙন বা বন্যা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই।

মুন্সীগঞ্জে পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত
মুন্সীগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, মুন্সীগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী সপ্তাহে পদ্মা নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে এবং জোলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবার আশংকা রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে জানা যায় বর্তমানে ভাগ্যকূল পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপদ সীমার ৫০ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী এক সপ্তাহে পদ্মা নদীর পানি বিপদ সীমা অতিক্রম করবে। গত কয়েকদিন পানি বৃদ্ধি পাওয়া লৌহজং উপজেলার খড়িয়া তালতলা এলাকায় নদী ভাংগন দেখা গিয়েছে। গত সাতদিনে ৫/৭টি বাড়ীঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মা সেতুর নিকটবর্তী এসব এলাকায় এ ভাংগন দেখা দিয়েছে। গত বছরও এ এলাকায় ভাংগন দেখা গিয়েছে। শিমুলিয়া বাজার থেকে বেদেপাড়া পর্যন্ত এ ভাংগন দেখা দেয়। খড়িয়া তালতলা এলাকার মোঃ বাদল হোসেন সব হারিয়ে এখন দিশেহারা। ১ একর জায়গা নিয়ে তার বসতবাড়ী ছিল। পদ্মা নদীল অব্যাহত ভাংগনে তার সম্পূর্ণ বাড়িটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পাশ্ববর্তী এলাকায় জায়গা ভাড়া নিয়ে ঘর উঠিয়ে থাকছেন। এলাকাবাসীর দাবী শিমুলিয়া বাজার থেকে বেদেপাড়া পর্যন্ত নদীশাসন করা।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/153703