১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১০:০৮

কারসাজিতে প্রতি বছরই কমছে চামড়ার দাম

দেশে পানির দরে বিক্রি হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি হচ্ছে

কোরবানির পশুর দাম প্রতি বছরই বাড়ছে। অথচ কমছে কাঁচা চামড়ার দাম। গত ৬ বছরে চামড়ার দাম গরুতে প্রতি বর্গফুটে ৪০ টাকা আর খাসিতে ৩৫ টাকা পর্যন্ত কমেছে। এর পেছনে পরিকল্পিত কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। চামড়া সংশ্লিষ্ট তিন সিন্ডিকেট সংগঠনের অনৈতিক তৎপরতার কারণেই দাম কমছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। কোরবানির মৌসুম এলেই তারা হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর আর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার মিথ্যা অজুহাতসহ নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছে। সরকারও এক্ষেত্রে প্রকৃত অবস্থা যাচাই করছে না। এমনকি ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। ফলে শেষ পর্যন্ত এ মহাজনি ব্যবসায়ীদের প্ররোচিত দামেই কোরবানির চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। দেশে চামড়া পানির দরে বিক্রি হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য বিক্রি হচ্ছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেশীয় চামড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিদেশে। বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে যেখানে সব ধরনের ভোগ্যপণ্য, শিল্প উপকরণ ও ব্যবহার্য পণ্য এবং সেবার দাম দফায় দফায় বেড়েছে, সেখানে স্বার্থসংশ্লিষ্ট এ তিন চক্রের যৌথ অপতৎপরতায় কাঁচা চামড়ার মূল্য প্রতি বছর কমেছে। এ তিন ব্যবসায়ী সংগঠন হচ্ছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন, ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস ফুটওয়্যার অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন।
সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, প্রতি বছর দেশে সংগৃহীত কাঁচা চামড়া দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজার ও বহির্বিশ্বে রফতানি মিলে প্রায় ২২ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। অথচ মুনাফালোভীদের চক্রান্তে কোরবানির চামড়া বেচাকেনা হচ্ছে নামমাত্র মূল্যে। এতে শরিয়তমতে কোরবানির চামড়ার হকদার দুস্থ ও এতিমরা প্রাপ্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর অনৈতিক মুনাফা করছে সংঘবদ্ধ অসাধু ব্যবসায়ীরা।
গত ৬ বছরে দেশে কোরবানির চামড়ার নির্ধারিত মূল্যস্তর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৫-৯০ টাকা এবং খাসি ৫০-৫৫ টাকা। ২০১৪ সালে তা ১৫ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় গরুতে ৭০-৭৫ টাকা আর খাসিতে ৩০-৩৫ টাকা। পরের বছর ২০১৫ সালে গরুর চামড়া ৫০ থেকে ৫৫ এবং খাসির চামড়ায় ২০-২৫ টাকা। ২০১৬ সালে গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল্য ঠিক করা হয় ৪৫-৫০ টাকা এবং খাসির ১৮-২০ টাকা। ২০১৭ সালে ছিল গরু ৫০-৫৫ এবং খাসি ২০-২২ টাকা। এ মূল্যস্তর কমে ২০১৮ সালে এসে দাঁড়ায় গরু ৪৫-৫০ টাকা এবং খাসি ১৮-২০ টাকা।
কম দামে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমছে। তাই বাংলাদেশেও এর দাম কমাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। তার দাবি, এ বছর চাহিদা কম। কারণ গত বছর কেনা ৪০ শতাংশ চামড়া এ বছরও রয়ে গেছে। তার ওপর আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা ক্রমাগতভাবে কমছে।

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস ফুটওয়্যার অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মাহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বায়নের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারপ্রবণতার বাইরে থাকার সুযোগ আমাদের নেই। এ নিয়ে চক্রান্তের গন্ধ খোঁজার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার মূল্য স্থিতিশীল। আবার চামড়াজাত পণ্যের দাম প্রতি বছরই বাড়ছে। তা সত্ত্বেও গত ৬ বছরে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রতিটি বৈঠকেই ট্যানারি মালিকরা ওই একই দাবি করে আসছেন। অন্যদিকে তারা শুধু চামড়ার দাম কমিয়েই বসে থাকছে না। লাভের ফাঁকফোকর যেখানেই পাচ্ছে সেখানেই তাদের স্বেচ্ছাচারিতা জেঁকে বসেছে। কারণ প্রতি বছর সংগ্রহকৃত ৬৫ লাখ পিস চামড়া এ গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর কাছেই যাচ্ছে। এর জন্য ব্যাংক থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬০০ কোটি টাকা ঋণও নিচ্ছেন। কিন্তু ওই ঋণের টাকায় প্রত্যন্ত এলাকা থেকে তারা সময়মতো চামড়া সংগ্রহ করছেন না। আবার আগের বছরের বকেয়া পরিশোধ না করেই পরের বছর চামড়া বাকিতে কিনে চলেছেন। এভাবে চামড়া ব্যবসায়ীদের বকেয়া পড়ে থাকছে বছরের পর বছর। এ কারণে মাঠ পর্যায়ের চামড়া সংগ্রহ করাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠছে। ঢাকা জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব মো. রবিউল আলম বলেন, সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণের বিষয়টি ব্যবসায়ীদের ওপর ছেড়ে দেয়াতে প্রতি বছরই এ নিয়ে খামখেয়ালিপনা হচ্ছে। বছর ঘুরতেই কমছে দাম। অথচ এটি দেশের মূল্যবান সম্পদ। আমরা এটিকে যথাযথভাবে রক্ষা করতে পারছি না।
জানা গেছে, কোরবানিতে চামড়ার সরবরাহ বেশি থাকায় বেঁধে দেয়া সর্বনিু দামেও বিক্রি করা যাচ্ছে না মাঠ পর্যায়ের চামড়া। বরং এ তিন চক্রের অভিনব সব কারসাজির কারণে তার চেয়েও কম দরে চামড়া বিক্রি হয়ে থাকে। ফলে ওই পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত দর না পাওয়ায় কোরবানির চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলারও খবর পাওয়া গেছে।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/economics/90884