১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১০:০৭

সাড়ে ৩ হাজার টাকার জুতা তৈরিতে খরচ ১২শ’ টাকা!

পানির দরের চামড়ায় তৈরি পণ্যে উচ্চ মুনাফা। নজরদারি নেই সরকারের

কাঁচা চামড়া বিক্রি হচ্ছে পানির দরে। অথচ চামড়াজাত পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়ছে। এ চামড়া বেশি ব্যবহৃত হয় জুতা বা স্যান্ডেলে। দেশের বিশাল বাজার ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে বাংলাদেশি জুতার চাহিদা। এ নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশীয় নামি ব্র্যান্ডগুলো বিদেশে উন্নতমানের জুতা রফতানি করলেও দেশের বাজারে বিক্রি করছে তুলনামূলক নিুমানের জুতা। অথচ দাম বিদেশি জুতার প্রায় সমান। রফতানির জুতা তৈরি হচ্ছে বিদেশি ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব কারখানায়। আর দেশে বাজারজাত হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্র জুতা প্রস্তুতকারীদের কারখানায় তৈরি জুতা। বিশেষ করে পুরানো ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে তৈরি হচ্ছে বহুজাতিক বাটাসহ দেশীয় একাধিক নামি কোম্পানির জুতা ও স্যান্ডেল।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এসব জুতা চামড়ার তৈরি বলে বিক্রি হলেও এতে প্রকৃত চামড়ার পরিমাণ অনেক কম। ব্যবহৃত চামড়ার মানও নিুমানের। ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলোর চাহিদা অনুযায়ী এসব ক্ষুদ্র কারখানায় নিুমানের উপকরণ দিয়ে কোটি কোটি জুতা ও স্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে। পরে কোম্পানির লোগো বা সিল মেরে তা বিক্রি করা হচ্ছে অভিজাত শপিংমলে। শুধু তাই নয়, এসব জুতা বা স্যান্ডেল তৈরিতে যে পরিমাণ ব্যয় হয় তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে বিক্রি করছে নামি ব্র্যান্ডগুলো। এতে মুনাফা অনেক বেশি হলেও ঠকছেন ক্রেতারা। নামি ব্র্যান্ডের জুতা কিনে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা।

ক্রেতাদের অভিযোগ, বাংলাদেশে এ বছর পশুর কাঁচা চামড়ার দাম গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিু পর্যায়ে রয়েছে। অথচ পানির দরের এ চামড়ায় তৈরি জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগের মতো চামড়াজাত পণ্যের মূল্য এখনও চড়া রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অভিজাত মার্কেটে এয়ার কন্ডিশনের ঠাণ্ডা ও ঝকঝকে কাচের ঘেরা ব্র্যান্ডের শো-রুম থেকে ক্রেতারা যে জুতা কিনছেন ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায়। সেই জুতা তৈরিতে খরচ হচ্ছে গড়ে মাত্র ১২ থেকে ১৪শ’ টাকা। এভাবে বিভিন্ন মূল্যের জুতায় মুনাফা হচ্ছে কমপক্ষে দ্বিগুণ। উৎপাদকদের দাবি জুতা তৈরিতে খরচ কম হলেও ভ্যাট, বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি, কর্মচারীসহ অভিজাত মার্কেটের ব্যয়বহুল ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ হিসেব করেই মূল্য নির্ধারণ করা হয়। তবে হিসেব করে দেখা গেছে, সাড়ে ৩ হাজার টাকা দামের জুতায় ব্র্যান্ড কোম্পানির মুনাফা হচ্ছে ১৪শ’ টাকা এবং উৎপাদনকারীর ৩২৫ টাকা। অর্থাৎ একটি জুতা থেকে ৫৩ শতাংশই মুনাফা যাচ্ছে ব্র্যান্ড কোম্পানির পকেটে। আর ২০ দশমিক ৩১ শতাংশ লাভ গুনছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নামি-দামি অনেক ব্র্যান্ড কোম্পানির শো-রুমে প্রদর্শিত জুতাটি তৈরি হয়েছে পুরনো ঢাকায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাড়াটে উৎপাদনকারী জুতাটি তৈরি করে দিচ্ছে। এরপর কোম্পানিগুলো নিজস্ব ব্র্যান্ডের লোগো সাঁটিয়ে সেগুলো প্রদর্শন করছে শো-রুমে। মূলত নজরদারি না থাকায় এ খাতে উদ্যোক্তারা ক্রেতার পকেট কাটছে।

কেন কাঁচামালের দরপতনের পরেও এসব পণ্যের এত চড়া দাম? পুরনো ঢাকার সিদ্দিক বাজারে কথা হয় একাধিক ছোট ছোট জুতা তৈরি কারখানা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। তারা নিজস্ব পরিচয়ে কথা বলতে নারাজ। কারণ হিসেবে জানান, পরিচয় প্রকাশ পেলে ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো আর জুতা তৈরির অর্ডার দেবে না। তবে একজন জুতা উৎপাদক স্বীকার করেন, ব্র্যান্ডের যে জুতা বাজারে বিক্রি হয় ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় সেই জুতা তারা তৈরি করে দেন ১২শ’ থেকে ১৩শ’ টাকায়। এর মধ্যে এক জোড়া সোলের গড় মূল্য ৪৫০ টাকা, এক জোড়া রাবারসহ (সোলের ওপরে ব্যবহার হয়) রেকসিনের মূল্য ৩শ’ টাকা, পশুর চামড়ার ব্যয় ৩শ’ টাকা, পেস্টিং ও আঠার খরচ গড়ে ৭৫ টাকা, প্রয়োজনীয় সুতা ৩০ টাকা, শ্রমিক ব্যয় ৭০ টাকা, কারখানা ভাড়া ৫০ টাকাসহ সব মিলিয়ে প্রায় ১২শ’ টাকা। এরপর উৎপাদনকারী ব্র্যান্ড কোম্পানির কাছে এ জুতা বিক্রি করছেন গড়ে ১ হাজার ৬৫০ টাকা। আর ব্র্যান্ডের লোগো লাগানোর পর কোম্পানিগুলো তা ক্রেতাদের হাতে তুলে দিচ্ছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায়।
জানা গেছে, বড় ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো নিজস্ব ডিজাইনের জুতা স্থানীয় কারখানা থেকে অর্ডার দিয়ে তৈরি করছে। এর আগে বিভিন্ন ডিজাইনের জুতা তৈরি করে ব্র্যান্ড কোম্পানির কাছে নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করতে হয়। ডিজাইন নির্ধারণের পর এর মূল্য ঠিক করে তৈরির অর্ডার দেয়া হয়। এসব ছোট কারখানায় তা তৈরির পর কোম্পানিগুলো নিজস্ব লোগো লাগিয়ে শো-রুমগুলোতে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করছে।
অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, ব্র্যান্ডের শো-রুমগুলোতে ১৬শ’ থেকে ১৭শ’ টাকায় যে জুতা বিক্রি হচ্ছে, তা তৈরিতে ব্যয় হচ্ছে মাত্র ৪৯০ টাকা। বাকি ১ হাজার ১১০ টাকার মধ্যে ব্র্যান্ড কোম্পানির মুনাফা হচ্ছে ৮শ’ টাকা এবং উৎপাদনকারী পাচ্ছে ৩১০ টাকা। অর্থাৎ এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো মুনাফা করছে প্রায় ১শ’ শতাংশ।

জুতা তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, শো-রুমে ১৬শ’ টাকায় বিক্রিত জুতা তৈরি করতে সোল বাবদ গড়ে ব্যয় হয় ১৪০ টাকা। এছাড়া অন্য উপকরণের মধ্যে রাবারসহ রেকসিন খরচ ৭০ টাকা, পশুর চামড়া ১৮০ টাকা, পেস্টিং ও আঠায় খরচ ২৫ টাকা, সুতা ১৫ টাকা, শ্রমিক ব্যয় গড়ে ২৫ টাকা এবং কারখানা ভাড়া ৩০ টাকা। উৎপাদনকারী তা ৮শ’ টাকায় তুলে দিচ্ছে কোম্পানিগুলোর হাতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় বর্তমানে ভালো একটি ব্র্যান্ডের চামড়া দিয়ে তৈরি একজোড়া জুতার দাম ৩ থেকে ৮ হাজার টাকা। অথচ এ জুতা তৈরিতে খরচ হচ্ছে অর্ধেকেরও কম। কাঁচামালের সঙ্গে তৈরি পণ্যের দামের অনেক পার্থক্য ক্রেতাদের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করছে। রাজধানীর এলিফ্যান্ড রোডে জুতা কিনতে আসা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকার চামড়ার জিনিস কিনছি ৬ হাজার টাকা দিয়ে এটি কোন ধরনের ব্যবসা। গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত চামড়ার দাম কমছে। কিন্তু জুতার দাম বেড়েই চলেছে। বিষয়টি অবাক হওয়ার মতোই। পশুর ক্রয় মূল্যের সঙ্গে তার চামড়ার দামের সামঞ্জস্য নেই। আবার চামড়ার সঙ্গে জুতার বিক্রির মূল্যের সঙ্গতি নেই। বিষয়টি সরকারের নজরে আসা উচিত।

https://www.jugantor.com/todays-paper/economics/90883