১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১১:০৬

বিনিয়োগ বেড়েছে কমেছে আয়

রেলে লোকসানের রেকর্ড

লোকসানে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে রেল। গত সাড়ে ৯ বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি লাভ তো দূরের কথা, পরিচালন ব্যয়ই তুলতে পারছে না। উল্টো আয় কমেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল এক হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। গত বছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৯৮ কোটি টাকায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে লোকসান ছিল এক হাজার ২২৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৪১৮ কোটি টাকা।

ব্রিটিশদের হাত ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে রেলের পত্তন। পাশের দেশ ভারতে রেল প্রতি বছর মুনাফা করলেও, বাংলাদেশে রেল বরাবরই লোকসানি খাত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রেলকে গুরুত্ব দেয়। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে রেলে অনুন্নয়ন (পরিচালনা) ব্যয়ের চেয়ে উন্নয়ন খাতে (প্রকল্প বাস্তবায়ন) বেশি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে রেলের পেছনে ব্যয় করা হয়েছে ১০ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই হাজার ৭১৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে পরিচালনায়। বাকি আট হাজার ১০১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর, গত ৯ অর্থবছরে (২০০৯-১০ থেকে ২০১৭-১৮) রেলের পেছনে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে ২৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। পরিচালন খাতে ব্যয় করা হয়েছে ১৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। বাকিটা উন্নয়ন প্রকল্পে। এত বিপুল ব্যয় সত্ত্বেও আয় বাড়েনি, বরং কমেছে।

রেলের অর্থ শাখা থেকে এ তথ্য পাওয়া পেছে। এ শাখার কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক হিসাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শুধু রেল পরিচালনায় ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। আয় হয়েছে ১ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। নিট লোকসান ১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। চূড়ান্ত হিসাবে আয়-ব্যয়ে সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা কম-বেশি হতে পারে। কিন্তু রেল যে গত অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ লোকসান করেছে তা প্রাথমিক হিসাবেই নিশ্চিত।

বিপুল বিনিয়োগের পরও রেলের দুর্দশার জন্য ১২ বছর আগে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া বিএনপি-জামায়াত সরকারকে দায়ী করেছেন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। ছয় বছর ধরে দায়িত্ব থাকা এই মন্ত্রীর দাবি, বিএনপি আমলে একের পর স্টেশন বন্ধ করা হয়েছে। রেলপথ বন্ধ হয়েছে। কোচ, ইঞ্জিন একটিও কেনা হয়নি। রেল মরে গিয়েছিল। এখনও তার জের টানতে হচ্ছে।

মন্ত্রী দাবি করেন, রেল আগামী কয়েক বছরেই ঘুরে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে ২৪টি প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে। আয় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। যাত্রী তিনগুণ হয়েছে। ৪৫টি প্রকল্পের কাজ চলছে। ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চলমান বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে রেল ঘুরে দাঁড়াবে এবং লাভ করবে।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেলের ভাড়া ৭ থেকে ৯ শতাংশ বাড়ানো হয়, এতে গত বছর আয় বাড়লেও এবার তা কমেছে। ২০১২ সালেও বেড়েছিল ভাড়া। অন্যান্য বারের মতো এবারও রেলের আয়ের বড় অংশ এসেছে যাত্রী পরিবহন থেকে। সেখানে লোকসানও বেশি। রেলের হিসাব শাখার তথ্য অনুযায়ী, যাত্রী পরিবহনে আগের চেয়ে আয় বাড়লেও তা ৫০০ কোটি টাকা ছাড়ায়নি।

আগের অর্থবছরে রেলের পরিচালনা খাতে ২ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা

ব্যয়ের বিপরীতে আয় ছিল ১ হাজার ৩০৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যাত্রী পরিবহনে আয় হয়েছে ৭৮৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। পণ্য পরিবহনে ছিল ২৮৩ কোটি টাকা। আয়ের মাত্র ২১ ভাগ এসেছিল পণ্য পরিবহন থেকে। এবারও পণ্য পরিবহনে আয়ের চিত্র খুব একটা বদলায়নি।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ১ হাজার ২৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। যাত্রী পরিবহনে আয় ছিল ৫৯৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। পণ্য পরিবহনে আয় হয় ২০৪ কোটি টাকা।

বিপরীতে ভারতীয় রেলের আয়ের বড় অংশই আসে পণ্য পরিবহন থেকে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ভারতীয় রেল আয় করেছে মোট ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি রুপি। এর মধ্যে পণ্য পরিবহনে আয় ছিল ১ লাখ ৯ হাজার কোটি রুপি।

রেল কর্মকর্তারা বলছেন, পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় লোকসানের বোঝা ভারি হচ্ছে বছর বছর। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান; তাই পণ্য পরিবহনের চেয়ে লোকসান সত্ত্বেও যাত্রী পরিবহনেই গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যাত্রী পরিবহনে পৃথিবীর সব দেশের রেলই লোকসান করে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। লোকসান পোষানো হয় পণ্য পরিবহনে। বাংলাদেশে রেলে পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় লোকসান বাড়ছে।

রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি রেলের আয় গড়ে ৫৬ পয়সা। ব্যয় এক টাকা ৫২ পয়সা। পণ্য পরিবহনে প্রতি টনে রেলের কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ২২ পয়সা, আয় হয় দুই টাকা ৫ পয়সা।

২০০১-০২ অর্থবছরেও পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের আয় ছিল প্রায় সমান। ১৬ বছর পর পণ্য পরিবহনে আয় নেমে এসেছে যাত্রী পরিবহনের চার ভাগের এক ভাগে। ২০০২-০৩ অর্থবছরে রেল পরিবহন করে তিন কোটি ৯১ লাখ ৬২ হাজার যাত্রী। একই সময়ে পণ্য পরিবহন করে ৩৬ লাখ ৬৬ হাজার টন। রেলে এখন যাত্রী প্রায় আট কোটি হলেও পণ্য পরিবহন কমে নেমেছে প্রায় ২৫ লাখ টনে।

রেলের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, এক দশক আগেও দেশের মোট আমদানি-রফতানি পণ্যের ১২ ভাগ রেলের মাধ্যমে পরিবহন করা হতো। এখন তা কমে পাঁচ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

কেন এ দুরবস্থা?

ওই কর্মকর্তা জানান, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ছয় ঘণ্টা। পণ্য পরিবহনে লেগে যায় দুই দিন। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের পুরোটা ডাবল লাইনে উন্নীত হয়নি। যাত্রীবাহী ট্রেনকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে, পণ্যবাহী ওয়াগনকে ঢাকা-চট্টগ্রাম পর্যন্ত অন্তত ১৪টি স্থানে 'ক্রসিং' (থামাতে হয়) দিতে হয়। এতে সময় বেশি লাগে। তাই রেল সাশ্রয়ী হলেও ব্যবসায়ীরা সময় বাঁচাতে সড়কপথে পণ্য পরিবহন করেন।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, পণ্য পরিবহনের ৯৫ ভাগই হয় সড়কপথে। নিরাপদ ও সাশ্রয়ী হওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা রেলে আগ্রহী নন, কারণ সময়ের অপচয়। রেলের পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়নি বলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

রেলে পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ার পাশাপাশি লোকসানের অন্যতম কারণ কোচ (বগি), ওয়াগন ও ইঞ্জিন সংকট। ২০১১ সালের আগের ১০ বছরে কোনো ইঞ্জিন কেনা হয়নি। বর্তমান সরকারে সময়ে যাত্রীবাহী বগি কেনা হয়েছে ২৭০টি। পণ্যবাহী ওয়াগন কেনা হয়েছে ৪৪৬টি। ইঞ্জিন সংগ্রহ করা হয়েছে ৪৬টি। তবে তাও চাহিদার তুলনায় অনেক কম। রেলে পণ্যবাহী আট হাজার ৬৮০টি ওয়াগনের মধ্যে তিন হাজার ৯৩৯টির আয়ুস্কাল পেরিয়ে গেছে।


বিগত আট বছরের হিসাব *হিসাব কোটি টাকায়

http://samakal.com/bangladesh/article/1809852