উদ্বোধনের আগেই ধসেপড়া দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর সংযোগ সড়ক :নয়া দিগন্ত
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১০:৩৭

উদ্বোধনের আগেই ধসে গেল দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর সংযোগ সড়ক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনের দুই দিন আগেই অবশেষে তিস্তার পানির তোড়ে ধসে গেল রংপুর-লালমনিরহাটের মহিপুর-রুদ্রেশ্বর সীমান্তে তিস্তা নদীর ওপর দ্বিতীয় সড়ক সেতুর উত্তরপ্রান্তের সংযোগ সড়ক। ফলে বহু প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দ্বার হিসেবে বিবেচিত দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতুটি এখন কার্যত লালমনিরহাটের সাথে বিচ্ছিন্ন। এ দিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই সড়কে স্বাভাবিক যোগাযোগ নিশ্চিত করার জন্য এলজিইডি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা এমপি। স্থানীয়রা বলছেন, স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতরের নজিরবিহীন গাফিলতির কারণে পাঁচ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের ভয়াবহ নড়বড়ে অবস্থার মধ্যেই আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টায় সেতুটির উদ্বোধন করবেন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। সেতুটির সংযোগ সড়ক নিয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর দৈনিক নয়া দিগন্তে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

ধসে গেল সংযোগ সড়কের সেতু : সরেজমিন দেখা গেছে তিন দফায় বিভিন্ন নামে নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে সংস্কার করার পরেও দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতুর উত্তরপ্রান্ত থেকে কাকিনা পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সড়কটি টিকে রাখতে পারল না কর্তৃপক্ষ। স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগ বাঁশের খুঁটি দিয়ে সংযোগ সড়কের ওই ব্রিজ এলাকাটি আটকে দিয়েছে। উৎসুক মানুষ ভিড় করছেন সেখানে। তারা জিও ব্যাগ ফেলে সড়কটি চালু করার চেষ্টা করছে। জরুরি প্রয়োজনে মানুষ এখন সেখানে নৌকায় চলাচল করছেন।

এর আগে জুলাই মাসে বন্যায় ব্রিজের মোকা ধসে পড়লে জোড়াতালি দিয়ে সংস্কার করেছিল সংশ্লিষ্ট দফতর। ফলে প্রধানমন্ত্রী সেতুটি উদ্বোধন করলেও সহসা কোনো যানবাহন বা পথচারী সরাসরি ওই ব্রিজ দিয়ে চলাচল করতে পারবে না। নৌকা দিয়ে পার হয়ে এসে উঠতে হবে সেতুতে। এই ঘটনায় ওই এলাকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এ দিকে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা এমপি গতকাল শুক্রবার নয়া দিগন্তকে জানান, আমাদের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন রোববার। এর আগে সংযোগ সড়কের ব্রিজের মোকা ধসে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। আমি এলজিইডি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছি আজ শনিবার বিকেল ৫টার মধ্যেই ধসে যাওয়া অংশ সংস্কার করে পুরোপুরি যোগাযোগ উপযোগী করতে। আমি বিকেলে সেখানে দেখতে যাবো। তিনি বলেন, এই সংযোগ সড়ক নির্মাণে অনিয়মের সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক শফিউল আরিফ সাংবাদিকদের জানান, দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। যথাসময়েই উদ্বোধন অনুষ্ঠান হবে। ধসে যাওয়া অংশ দ্রুত মেরামত বা সাময়িক যোগাযোগের জন্য ব্যবস্থা করতে প্রকৌশল বিভাগ কাজ করছে।
সংযোগ সড়ক নির্মাণে নিম্নমানের কাজ ও ধসে যাওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি কালীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী পারভেজ নেওয়াজ খান। তবে তিনি বলেন, নদী প্রতিমুহূর্তে গতিপথ পরিবর্তন করে থাকে। সেতু নির্মাণের পরিকল্পনার সময়ের গতিপথ অনুযায়ী সেতু ও নদী শাসন বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এখন নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। সেটা দেখার কাজ আমার নয়, এটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ। তারা দেখবে।
স্থানীয় অধিবাসী ফারুক হোসেন জানান, সংযোগ সড়ক নির্মাণের শুরু থেকে কাজের মান নিয়ে অভিযোগ করেও সুফল মেলেনি। কাজ যে নিম্নমানের হয়েছে সে বিষয়টি ঢাকা দিতে চার দফায় সংস্কার করেও চলাচলের উপযোগী করতে পারছে না প্রকৌশল অধিদফতর। নদী শাসনের ১৩০০ মিটার বাঁধ অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। এখন লোকালয় ভাঙার পাশাপাশি পাঁচ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে যাচ্ছে। ফলে উদ্বোধনের আগেই দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতুটি অকার্যকর হয়ে পড়ল।

এ দিকে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার এই সেতুটির সংযোগ সড়ক বেহাল দশায় উদ্বিগ্ন সবাই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেতুটি চালু হলেও ভারী যানবাহনের বোঝা নেয়ার মতো সক্ষমতা নেই সংযোগ সড়কটির। এ ছাড়াও নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে যেকোনো মুহূর্তে সড়কটি পুরোটাই ধসে গেলে কোনো কাজে আসবে না তিস্তা সড়ক সেতুটি।
অনুসন্ধানে এলজিইডি, স্থানীয় লোকজন এবং বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, পাঁচ কিলোমিটার সংযোগ সড়কটিতে দুই ফুট এঁটেল মাটি দেয়ার কথা থাকলেও শুধু বালুর ওপর নি¤œমানের খোয়া দিয়ে দায়সারা কাজ করা হয়েছে। সে কারণে সড়কটি ধসে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রংপুর চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম নয়া দিগন্তকে জানান, এই সেতু নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বুড়িমারী স্থলবন্দরকে আরো বেশি কার্যকর করা, ব্যবহার করা। ভারত, নেপাল ও ভুটানের সাথে আমাদের যে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য সেটি এই সেতুর মাধ্যমে আরো সম্প্রসারণ হবে।

তিনি জানান, উদ্বোধনের আগেই সড়ক ধসে গেল। তাহলে সেতুটি প্রধানমন্ত্রী চালু করে দিলেই পাথরবোঝাইসহ ভারী যানবাহন চলাচল যখন শুরু হবে। তখন কোনোভাবেই বালুর ওই সংযোগ সড়ক টিকবে না।
এ ব্যাপারে লালমনিরহাট এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম জাকিউর রহমান জানান, তিস্তা গতিপথ পরিবর্তন করায় পানির স্রোতে সংযোগ সড়কের ইচলি এলাকার ব্রিজটির মোকা ধসে গেছে। এখন সড়কটিতে আপাতত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে।
যেভাবে শুরু হলো দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতুর কাজ : স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) রংপুর জোনাল অফিস সূত্র জানায়, দীর্ঘ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ২২ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী পরিষদের (একনেক) বৈঠকে বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুরে গ্রামীণ যোগাযোগ ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের মহিপুর এবং লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের রুদ্রেশ্বর সীমান্তে তিস্তা নদীর ওপর ৮৫০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ফুটপাথসহ ৯ দশমিক ৬ মিটার প্রস্থের দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু নির্মাণের জন্য ১২১ কোটি ৬৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকা বরাদ্দ অনুমোদন করে সরকার। এরপর টেন্ডার আহ্বান করা হলে সেতুটি নির্মাণের কার্যাদেশ দেয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডব্লিউ এমসিজি নাভানা কনস্ট্রাকশনকে। ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সেতুটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এলজিইডি সূত্র মতে, একনেকে পাস হওয়া শিডিউল অনুযায়ী সেতুতে যানবাহন চলাচলের জন্য বরাদ্দ আছে ৭ দশমিক ৩ মিটার। দুই পাশে ফুটপাথ আছে শূন্য দশমিক ৯ মিটার। সেতুটিতে ১৬টি পিলার, দু’টি অ্যাপার্টমেন্ট, ১৭টি স্প্যানে ৮৫টি গার্ডার আছে। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্র্ঘ্য ৫০ মিটার। এ ছাড়াও আছে সেতুটির উভয় পাশে এক হাজার ৩০০ মিটার নদী শাসন বাঁধ এবং সেতুর উত্তর প্রান্ত থেকে লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের কাকিনা পর্যন্ত ৫ দশমিক ২৮০ কিলোমিটার সড়ক ও দু’টি ব্রিজ, তিনটি কালভার্ট, সেতুর দক্ষিণপ্রান্ত থেকে রংপুরের অংশে ৫৬৩ মিটার সড়ক। এসব কাজই ২০১৪ সালের ৩১ জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এলজিইডি এবং ঠিকাদারি কর্তৃপক্ষের নানা অজুহাতে তিন দফা সময় ও নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে সেতুটির কাজ শেষ হয় ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এতে সেতুটির মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১৩১ কোটি ৮৬ লাখ টাকায়।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/349100