১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৫

এই সময়ের ইতিহাসও লেখা হবে

উন্নত জীবনযাপনের জন্য মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে, রাষ্ট্র গঠন করেছে। রাষ্ট্র মানুষকে আইনের শাসন তথা সুশাসন প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এই অঙ্গীকার পালিত হলে নাগরিকরা ভালো থাকে, আর ব্যত্যয় ঘটলে নাগরিকদের দুঃখের সীমা থাকে না। এমন এক চিত্র লক্ষ্য করা গেল গত ১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে যাত্রীকল্যাণ সমিতির সংবাদ সম্মেলনে । দেড় ঘণ্টার সংবাদ সম্মেলনের পুরোটা সময় তিন বছরের মেয়ে ফাতেমা তুজ জহুরাকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন রিজু আক্তার। তার স্বামী বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। স্বামীর মুক্তির দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলতে গিয়ে শুধুই কাঁদলেন। বারুবার চোখ মুছলেন। কান্নার মধ্যে শুধু বলতে পারলেন, ‘আমি এখন কোনো কথা বলার মতো মানসিক অবস্থায় নেই। শুধু প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, যেন আমার স্বামীকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দেয়া হয়।’ ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট নাগরিকরাও। সেখানে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, আদালত কাউকে শাস্তি না দিলে বিশেষ কারণ ছাড়া রাষ্ট্র মানুষের জীবনের একটি ঘণ্টাও আটকে রাখার অধিকার রাখে না। কিন্তু দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিনিয়ত বিশেষ ক্ষমতা খাটিয়ে দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ওই কাজটা (আটকে রাখা) করে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এই সময়ের ইতিহাস যখন লেখা হবে, তখন কিন্তু এভাবেই বলা হবে যে- কেউ যদি মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতো, তবে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হতো, নির্বিচারে জেলে পোরা হতো। তিনি বলেন, যাত্রী কল্যাণ সমিতি সব যাত্রীর পক্ষ থেকে শুধু এটুকুই বলেছে যে, রাস্তায় বের হলে যেন তারা নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারে। এমন নিরীহ একটি সংগঠনের নেতাকে যদি রিমান্ডে নেয়ার মতো ঘটনা ঘটে, তাহলে বিস্মিত হওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলতে হয়, হতবাক হতে হয়। অথচ সব ক্ষেত্রে শোনানো হচ্ছে, সরকার গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখছে, তাদের উন্নয়নের কোনো তুলনা নেই।

মানবাধিকার কর্মী এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল নাগরিকদের অধিকার ও রাস্ট্রের কর্তব্য প্রসঙ্গে যে বক্তব্য রেখেছেন তা যৌক্তিক বলেই আমরা মনে করি।
নাগরিকরা তো আইনের শাসন চায়, সুশাসন চায়। তাদের এমন আকাক্সক্ষা পূরণে আদালতের করণীয় আছে, করণীয় আছে পুলিশ প্রশাসনেরও। সরকারের দায়িত্বও গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাও এ প্রসঙ্গে উঠে আসে। প্রসঙ্গত এখানে ‘বাদী চেনেন না, মামলা করল কে?’ শিরোনামের খবরটির কথা উল্লেখ করা যায়। ৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয়, যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে পেশাদার চাঁদাবাজ আখ্যায়িত করেছে মিরপুর থানার পুলিশ। গত শনিবার তাকে পুনরায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করা হয়। আদালত অবশ্য মোজাম্মেলকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ।

মোজাম্মেলের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আদালতকে বলেছেন, মামলার বাদীই গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন আসামীকে তিনি চেনেন না। তাহলে মোজাম্মেলের বিরুদ্ধে মামলা করল কে? এটা সাজানো মিথ্যা মামলা। উল্লেখ্য যে, গত মঙ্গলবার চাঁদাবাজির এ মামলা করেন কথিত মিরপুর রোড শ্রমিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ দুলাল। তবে দুলাল গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি নেতা নন, কোন পদবীও তার নেই। তিনি ঢাকা চিড়িয়াখানা পরিবহনের লাইনম্যান। দুলাল আরও বলেন, নতুন পরিবহন কোম্পানি খোলার কথা বলে মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের মিরপুর শাখার সভাপতি আবদুর রহিম ও সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন তার স্বাক্ষর নেন এবং পরে তিনি জানতে পারেন সেই স্বাক্ষরে মামলা করার কথা। উল্লেখ্য যে, যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়ক দুর্ঘটনা, বাড়তি ভাড়াসহ পরিবহন খাতের নানা অসঙ্গতি নিয়ে কয়েক বছর ধরেই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। এতে বিশেষ মহল সমিতির নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হতে পারে।

এছাড়া দুই ঈদের পরেই দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের সংখ্যা তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন করেছিল যাত্রী কল্যাণ সমিতি। পরে গত ১০ জুলাই সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনার প্রতিবেদনকে ভুয়া বলে মন্তব্য করেন।
আমরা মনে করি, কোন প্রতিবেদনকে ভুয়া প্রমাণ করতেও তথ্য-প্রমাণ প্রয়োজন। আর যে আসামীকে খোদ বাদীই চেনেন না, সেখানে তো সন্দেহের উদ্রেক হবেই। এখানেই চলে আসে ন্যায় ও সুশাসনের প্রসঙ্গ। এই মামলায় পুলিশ প্রশাসন ও আদালতের ভূমিকা নাগরিকদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমরা ন্যায় ও সত্য প্রকাশের অপেক্ষায় আছি। তবে পত্রিকায় যখন গায়েবি মামলার খবর মুদ্রিত হয়, তখন আমাদের আশাবাদ বাধাগ্রস্ত হয়। ৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, রাজধানীর চকবাজার থানা বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল আজিজুল্লাহ মারা গেছেন ২০১৬ সালের মে মাসে। মৃত্যুর প্রায় ২৮ মাস পরে তাঁকে একটি মামলায় আসামী করেছে পুলিশ। প্রয়াত এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ, ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় তিনি পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়েছেন। এমনকি অন্য নেতাকর্মীদের সঙ্গে ককটেলের বিস্ফোরণও ঘটিয়েছেন। এই মামলার আর এক আসামী বিএনপি সমর্থক আব্দুল মান্নাফ ওরফে চাঁন মিয়া। অথচ হজ্ব করতে ৪ আগস্ট তিনি সৌদি আরব যান। এখনো দেশে ফেরেননি তিনি। এই যদি হয় পুলিশের মামলার নমুনা, তাহলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে কেমন করে? এই প্রশ্নের জবাব তো সরকারকেই দিতে হবে।

 

http://www.dailysangram.com/post/345326