১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১১:২৯

আসল মেয়র বিদেশে নকল মেয়র জেলে

গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনিছুর রহমান পল্লী উন্নয়ন বিষয়ক এক সম্মেলনে যোগ দিতে ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছেন। কিন্তু অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় মেয়র আনিছ সেজে আদালতে হাজির হন এক ব্যক্তি। আত্মসমর্পণ দেখিয়ে চারটি মামলায় আসামির জামিন চান তাঁর আইনজীবী। গত রবিবার ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ মিজানুর রহমান খানের আদালত এক মামলায় তাঁকে জামিন দেন। অন্য তিন মামলায় জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে পাঠানো হয় কারাগারে। আসামি জালিয়াতির আশ্রয় নিলেও তাৎক্ষণিকভাবে তা আঁচ করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কেউ।

মেয়র আনিছের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর খবর জানাজানি হওয়ায় তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সরব হয়ে প্রমাণ করতে চান যে মেয়র ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছেন। ফলে পুরো পৌরবাসীর মধ্যেই প্রশ্ন ওঠে, মেয়র আনিছুর রহমান জেলে নাকি বিদেশে! এ অবস্থায় গতকাল সোমবার বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে পুলিশকে তা তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে নূরে আলম মোল্লা জালিয়াতির ঘটনা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন।
জানা যায়, ঢাকার পুলিশ উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মোহাম্মদ আনিসুর রহমান নূরে আলম জালিয়াতির বিষয়টি গতকাল আদালতের নজরে আনেন। পরে নূরে আলমের বক্তব্য শুনে বিচারক তাঁর আদালতের সেরেস্তাদারকে মামলা করার নির্দেশ দেন। জানা গেছে, মিথ্যা পরিচয় দিয়ে অন্য একজনকে দাঁড় করানো এবং মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আদালতে হাজিরা দেওয়ায় মেয়র আনিছ ও নূরে আলমের বিরুদ্ধে গতকালই ডিএমপির কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আসল মেয়র গত গত ৮ সেপ্টেম্বর রাতে সরকারি সফরে ইন্দোনেশিয়ায় যান। পরদিন মেয়র সাজিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করানো হয় নূরে আলম মোল্লাকে (৪৫)। শ্রীপুর পৌর এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ ভাংনাহাটি গ্রামের মৃত তফিল উদ্দিন মোল্লার ছেলে নূরে আলম মোল্লা মেয়রের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।

যে তিন মামলায় আনিছের জামিন নামঞ্জুর করা হয় তার একটির ধার্য তারিখ ছিল গতকাল সোমবার ওই আদালতেই। ফলে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয় আনিছুর রহমানবেশী নূরে আলমকে। আদালতের হাজতখানা থেকে কারাগারে পাঠানোর সময় নূরে আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, মেয়র আনিছ তাঁর বন্ধুর ভাই। মেয়রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মেয়র বিদেশ যাওয়ার আগে তাঁকে ঢাকার আদালতের ঝামেলা মেটাতে বলেন। মেয়রের কথামতো নূরে আলম গত রবিবার ঢাকায় আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করেন। আইনজীবীর কথা অনুযায়ী মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আদালতে দাঁড়ান তিনি। তাঁকে বলা হয়েছিল, আদালতে দাঁড়ানোর পর জামিন হয়ে যাবে। কোনো সমস্যা হবে না।
নূরে আলম আরো বলেন, ‘আমি জেনেশুনেই আনিছুর রহমানের পরিবর্তে আদালতে দাঁড়িয়েছি।’ জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়ার সময় তিনি আদালতকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন কি না জানতে চাইলে নূরে আলম বলেন, ‘না’। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কারাগারেও আনিছুর রহমান পরিচয় দিয়েছি।’ গত রবিবার চারটি মামলায় মেয়র আনিছের পরিচয় দিয়ে নূরে আলম আত্মসমর্পণ করেন। দুটি মামলায় আত্মসমর্পণ করেন আবদুল মান্নান।
দুদকের আইনজীবী রুহুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আসামি নূরে আলম শ্রীপুরের মেয়র আনিছুর রহমান পরিচয় দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। আমাদের আসামির পরিচয় নিশ্চিত করার দায়িত্ব নয়। আমরা আসামির জামিনের বিরোধিতা করেছি। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছেন। এখন পরিচয় জানার পর তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
এদিকে মিথ্যা পরিচয়দানকারী নূরে আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, রেজাউল করিম নামের একজন আইনজীবীর কাছে তাঁরা এসেছিলেন। তিনিই তাঁদের আত্মসমর্পণ করিয়েছেন। কে শুনানি করবেন এটাও তাঁরা জানতেন না।
পদ ছাড়াই প্রভাবশালী নূরে আলম মোল্লা : জেলা বা পৌর আওয়ামী লীগের কোনো পদে না থাকলেও এলাকার সবাই একজন ‘প্রভাবশালী নেতা’ হিসেবেই চেনে নূরে আলম মোল্লাকে। সেই সঙ্গে লোকে তাঁকে জানে মেয়র আনিছুর রহমানের আস্থাভাজন কর্মী হিসেবে। নূরে আলম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজেরও অনুসারী। পেশায় তিনি ঠিকাদার। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে পৌরসভা থেকে অবৈধ সুবিধা নেওয়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। অনেকেই অভিযোগ করেন, দাপট দেখিয়ে পৌরসভায় টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করাসহ অস্তিত্ববিহীন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ বরাদ্দ করিয়ে তা আত্মসাৎ করে বিপুল অর্থের মালিক বনে গেছেন নূরে আলম। তাঁকে অবৈধ সুবিধা দিতে না চাওয়ায় বিভিন্ন সময় লাঞ্ছিত বা অপদস্থ হতে হয়েছে অনেক কর্মকর্তাকেও।
মেয়র আনিছুর রহমানের ছোট ভাই মাওনা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোখলেছুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে সব সময়ই জোঁকের মতো লেগে থাকে নূরে আলম মোল্লা। তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ, আমার ভাইকেও অনেকবার বলেছি তা। দুদকের করা মামলা দেখিয়ে আমার ভাইয়ের কাছ থেকে অনেক টাকাও নিয়েছেন নূরে আলম।’
নূরে আলম মোল্লার পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য জানতে গতকাল দুপুরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গেটে তালা ঝুলছে। ভাড়াটিয়া নূরজাহান বেগম জানান, নূরে আলম মোল্লার স্ত্রী গতকাল সকাল ৭টার দিকে ঢাকায় গেছেন। তাঁর মাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে পরিবারের কারো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

মেয়র আনিছুর রহমান পৌরসভা কার্যালয়ে যতক্ষণ থাকতেন, ততক্ষণই তাঁর কাছাকাছি থাকতেন নূরে আলম মোল্লা। এর পরও ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার দু-তিন দিন আগে নূরে আলম মোল্লার সঙ্গে কয়েক দফা একান্ত বৈঠক করেন মেয়র। নির্ভরশীল একটি সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ বৈঠক হয় গত শুক্রবার রাতে মেয়রের বাসায়। ওই বৈঠকে পৌরসভার এক ‘মাস্টার রোল’ কর্মচারীও উপস্থিত ছিলেন। পৌরসভার এক কর্মচারী জানান, মেয়রের ব্যক্তিগত অনেক বিষয়ই দেখভাল করতেন নূরে আলম মোল্লা।
পৌরসভার সচিব বদরুজ্জামান বাদল বলেন, ‘মেয়রের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তা মেয়র নিজেই দেখেন।’ আদালতে জালিয়াতির প্রসঙ্গে সচিব বলেন, ‘আট দিনের সফরে মেয়র গত ৮ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় মালিন্দো এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ইন্দোনেশিয়া যান। ফিরবেন আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর। এটি তাঁর সরকারি সফর। আমিসহ কয়েকজন কাউন্সিলর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু রবিবার সন্ধ্যায় মেয়র সেজে নূরে আলম মোল্লার আদালতে জামিন নিতে যাওয়ার ঘটনাটি জানলাম।’

২০১০ সালের বিভিন্ন সময়ে শ্রীপুর পৌরসভার বিভিন্ন হাটবাজার ইজারা দেওয়া ৬০ লাখ টাকার বেশি আত্মসাৎ করার অভিযোগে মেয়র আনিছুর রহমান ও পৌরসভার সাবেক হিসাবরক্ষক আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে চারটি মামলা করেন দুদকের উপসহকারী পরিচালক ফখরুল ইসলাম। চার্জশিট হওয়ার পর মামলা চারটি বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/09/11/678818