ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ লাগামহীন গতিতে বেড়েই চলেছে। খেলাপি ঋণের ভয়ানক ছোবলে বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৫ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। ফলে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা।
এসব ঋণ আটকে থাকায় এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর কোনো আয় হচ্ছে না। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য মন্দঋণের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। যার বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণের সঙ্গে প্রভিশনের অর্থও আটকে রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এটি হচ্ছে খেলাপি ঋণের অফিসিয়াল চিত্র। এর বাইরেও আরও খেলাপি ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের প্রায় ৫৫ হাজার ৩১১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন বা রাইটঅফ করা হয়েছে। এ ঋণ যোগ করলে দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
এছাড়াও খেলাপি ঋণ থেকে পুনঃতফসিল করা হয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকা, পুনর্গঠন করা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং ব্যাংকের পরিচালকরা ভাগাভাগি করে নিয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণের অধিকাংশ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ঋণ অবলোপন যেটা দেখানো হয়, সেটা প্রকৃত অবলোপন নয়। প্রকৃত অবলোপন অনেক বেশি। অবলোপনের প্রকৃত তথ্য গোপন করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে।
ব্যাংকগুলোর দেয়া ৩০ জুন ভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকায়।
২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। ওই ছয় মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৫ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত মার্চ পর্যন্ত বেড়েছিল ১৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা এবং এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বেড়েছে ৭৫১ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে গত বছরের শেষের দিকে কিছুটা কমিয়ে এনেছিল ব্যাংকগুলো। তবে ছয় মাস যেতে না যেতেই পুরনো চেহারায় ফিরেছে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ আদায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। নিজেদের সম্পদ রক্ষায় নিজেরা উদ্যোগ না নিলে এগুলো আদায় হবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে ডিসেম্বরে বাছবিচার ছাড়াই সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। কিন্তু জুনে এসে পুনঃতফসিলকৃত ঋণসহ নতুন ঋণও খেলাপি হয়ে পড়েছে। এছাড়া বিশেষ সুবিধায় ২০১৫ সালে পুনর্গঠন করা ঋণের বড় একটি অংশও এখন খেলাপি। সব মিলিয়ে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সুশাসনের অভাবে ব্যাংকগুলোয় অনিয়ম-দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। পরিচালকরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চান।
তাদের কারণে এমডিরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। আবার ব্যাংকারদের একাংশের অযোগ্যতা-দুর্বলতার কারণেও সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। পরিস্থিতি উন্নয়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণের কারণে শুধু যে খেলাপির অংশই আটকে থাকছে তা নয়। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন রাখতে হয়। ওইসব অর্থও আটকে থাকছে। খেলাপির কারণে বিপুল পরিমাণ তহবিল আটকে থাকায় ব্যাংকগুলোর আয় কমে গেছে।
উল্লেখ্য, প্রতি তিন মাস অন্তর দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ও খেলাপি ঋণের প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত, বেসরকারি ও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। চলতি বছরের জুনের খেলাপি ঋণের প্রতিবেদন সোমবার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে এর পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে ছয় মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা।
গত ডিসেম্বরে দেশের ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, যা ওই সময়ে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। চলতি বছরের জুন শেষে এ ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, এক দশক ধরে গুণগত মানের দিক থেকে যেসব খারাপ ঋণ দেয়া হয়েছে, সেগুলো ধীরে ধীরে খেলাপি হচ্ছে। এছাড়া পরিচালকদের ভাগাভাগি করে নেয়া ঋণও খেলাপি হয়ে পড়ছে। এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে। তা না হলে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এতে দেশের সার্বিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
খেলাপি ঋণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। বরং হতাশাই রয়ে গেল। কারণ শীর্ষ খেলাপিদের নাম প্রকাশের সুপারিশ করেছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বিদায়ী সচিব। সেটা আজও কার্যকর হয়নি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের ১ লাখ ৫১ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৪২ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা, যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। ছয় মাস আগে এ ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা বা বিতরণকৃত ঋণের ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ।
২০১৮ সালের জুন শেষে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৩৮ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা, যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। ছয় মাস আগে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ২৯ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।
চলতি বছরের জুন শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ৩৪ হাজার ৮৪ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ২৭১ কোটি টাকা, যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ছয় মাস আগে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা।
অন্যদিকে এ সময়ে সরকারি মালিকানার দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা, যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২১ দশমিক ৬৮ শতাংশ।