ছবি: সংগৃহীত
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১১:২২

সরকারের গচ্চা ২ মাসে সাড়ে ২৩ কোটি টাকা

সিএসডির ম্যানেজার প্রত্যাহার * জড়িত থাকতে পারে একাধিক রাঘববোয়াল

নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি দিয়ে খাদ্যশস্য খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস) না করে পাচার করায় গত দু’মাসে সরকারের গচ্চা গেছে কমপক্ষে সাড়ে ২৩ কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে ১৭ হাজার ৩১৬ টন চাল ও আটা তেজগাঁও কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদাম (সিএসডি) থেকে রাতের আঁধারে পাচার হয়েছে বলে র্যা বের প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে।

ইতিমধ্যে ২১৫ টন খাদ্যশস্য জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় সোমবার সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন কবিরকে প্রত্যাহার করে খাদ্য অধিদফতরের সহকারী উপ-পরিচালক একরামুল হক ভুঁইয়াকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। হুমায়ুন কবিরসহ দু’জনকে শনিবার রাতে আটক করেছিল র্যা ব। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ২০ ঘণ্টা পর তাদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।
এ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের নাম উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে র্যা ব। শিগগির এটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হবে। র্যা বের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদাম থেকে এগুলো ম্যানেজার হুমায়ুন কবিরের তত্ত্বাবধানে পাচার হতো।
এদিকে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট থেকে ১০০ টন ওএমএস’র শস্যপণ্য উদ্ধারের ঘটনায় র্যা ব ১৩ জনের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করা প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তবে র্যা বের ধারণা, এ ঘটনায় খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সংশ্লিষ্টরা জড়িত থাকতে পারেন। নিরপেক্ষভাবে তদন্ত হলে এসব ‘রাঘববোয়াল’র নাম বেরিয়ে আসবে।

র্যা ব কর্মকর্তাদের ভাষ্য- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির চাল ও আটা সিএসডি থেকে রাতের আঁধারে দুই মাসের বেশি সময় ধরে পাচার করেছেন তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ করছিলেন সিএসডির সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ম্যানেজার হুমায়ুন কবির।
দুই মাসে এই সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা। তারা প্রতিদিন ৩৩৩ টন খাদ্যশস্য পাচার করছিল। এই হিসাবে দুই মাসে প্রায় ১৭ হাজার ৩১৬ টন খাদ্যশস্য পাচার করেছে। ভর্তুকি দিয়ে কেনা এই খাদ্যশস্য দীর্ঘদিন ধরে পাচার হওয়ায় জনগুরুত্বপূর্ণ এই কর্মসূচি কোনো কাজেই আসছে না।
টিআইবির ট্রাস্টি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান যুগান্তরকে বলেন, ওএমএস-এ অনেক আগে থেকেই দুর্নীতি ছিল। এই দুর্নীতির সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত আছে বলে মনে হয়। তাদের সহায়তা ছাড়া ওএমএস’র চাল পাচার সম্ভব নয়। তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, খাদ্যশস্য পাচারের সঙ্গে যারাই জড়িত হোক তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে, তারা তদন্ত করে দেখছে।
এদিকে পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে শনিবার রাতে র্যা ব সিএসডির দুই কর্মকর্তাকে আটক করেছিল। রোববার খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা তাদের ছাড়িয়ে এনেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, সিএসডির দুই কর্মকর্তাকে কেউ ছাড়িয়ে আনেননি। র্যা ব তাদের খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করেছে।
এদিকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য পাচারের সঙ্গে সিএসডির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে র্যা ব। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দু-একদিনের মধ্যেই এ প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
ওই প্রতিবেদনে সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন কবির, গুদামের ইনচার্জ মনিয়ার হোসেন, স্টোক ইনচার্জ সুখরঞ্জন হালদার, ডিও শাখার ইনচার্জ কাজী মাহমুদুল হাসান, গেট শাখার ইনচার্জ ইউনূছ আলী মণ্ডল, প্রধান নিরাপত্তারক্ষী মো. হারেছ, নিরাপত্তারক্ষী মো. বাবুল, ওজন পরিমাপক সুমন এবং দুলালের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জানতে চাইলে র্যা বের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ওএমএস’র চাল ও আটা রাতের আঁধারে সিএসডি থেকে পাচার করা হচ্ছিল। পাচারের সঙ্গে সিএসডির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে দুদকে প্রতিবেদন পাঠানো হবে। মোহাম্মদপুরের অভিযানে বিপুল পরিমাণ চাল ও আটা উদ্ধারের ঘটনায় থানায় একটি মামলার প্রস্তুতি চলছে।
উল্লেখ্য, শনিবার রাতে তেজগাঁওয়ের কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদাম (সিএসডি) থেকে পাচার হওয়ার সময় আট ট্রাকভর্তি ১১৫ টন চাল ও আটা জব্দ করে র্যা ব। তাৎক্ষণিকভাবে সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন কবির এবং গুদাম ইনচার্জ মনিয়ার হোসেনকে আটক করা হয়।

যদিও পরে তাদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রোববার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত কৃষি মার্কেটে অভিযান চালিয়ে ১১টি আড়ত থেকে ওএমএস’র আরও ১০০ টন চাল ও আটা জব্দ করা হয়।
এ ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো সংগ্রহ করে দুদকের বাছাই কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির উপপরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বাছাই কমিটি প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ওএমএস কাজেই আসছে না : র্যা বের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, নিত্যপণ্য চাল ও আটা নিু আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য ওএমএস কর্মসূচি নিয়েছিল সরকার। এতে করে নিু আয়ের মানুষ যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলায় এই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ওএমএস’র শস্যপণ্য পাচার করে দেয়ায় এ কর্মসূচি সাধারণ মানুষের কোনো কাজেই আসছে না।
র্যা ব জানায়, রাজধানীর ১৪১টি পয়েন্টে ১৪১টি ট্রাকে করে প্রতিদিন ১৪১ টন চাল এবং ২৮২ টন গম খোলাবাজারে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি হওয়ার কথা। অথচ খোলাবাজারে বিক্রি হতো মাত্র ৩০ টন চাল এবং ৬০ টন গম। বাকি পণ্য রাতের আঁধারে পাচার করা হতো। এই হিসাবে প্রতিদিন পাচার হতো ১১১ টন চাল ও ২২২ টন আটা।

প্রতি কেজি চাল সরকার ৩৯ টাকা দরে কিনে ৩০ টাকা ধরে বিক্রি করত। প্রতি কেজি চালে সরকার ভর্তুকি দেয় ৯ টাকা। এই হিসাবে প্রতিদিন পাচার হওয়া চালে সরকার ভর্তুকি দিত ৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। দুই মাসে কমপক্ষে ৫২ দিন খোলাবাজারে চাল বিক্রি হওয়ার কথা। এ হিসাবে এ সময় পাচার হওয়া চালে সরকারের ভর্তুকি ৫ কোটি ১৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।
এদিকে ওএমএস’র প্রতি কেজি আটা সরকার কেনে ৩২ টাকায়। প্রতি কেজি আটা খোলাবাজারে বিক্রি হয় ১৬ টাকা ধরে। এক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দেয় ১৬ টাকায়। এ হিসাবে প্রতিদিন পাচার হওয়া ২২২ টন আটায় সরকারের গচ্চা গেছে ৩ লাখ ৫৫ লাখ দুই হাজার টাকা।
এ হিসাবে দুই মাসে পাচার হওয়া ওএমএস’র আটায় সরকার ১৮ কোটি ৪৮ লাখ চার হাজার টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। দুই মাসে পাচার হওয়া ১৭ হাজার ৩১৬ টন খাদ্যশস্যে সরকারের গচ্চা গেছে ২৩ কোটি ৬৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা।

প্রতি টন পাচারে ম্যানেজার পেত এক হাজার টাকা : প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে র্যা ব বলছে, প্রতি টন চাল ও আটা পাচারে সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন কবির পেতেন এক হাজার টাকা। এই হিসাবে প্রতিদিন পাচার হওয়ায় ৩৩৩ টন চাল ও আটা পাচারে তিনি হাতিয়ে নিতেন ৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা।
এ হিসাবে দুই মাসে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন ১ কোটি ৭৩ হাজার ১৬ হাজার টাকা। অপরদিকে প্রতি টন খাদ্যশস্য পাচারে খাদ্যগুদামের ইনচার্জ মনিয়ার হোসেন থেকে শুরু করে গেটম্যান পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেত ৫০০ টাকা। এই হিসাবে প্রতিদিন তারা হাতিয়ে নিত ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫০০ টাকা।
এই হিসাবে দুই মাসে তারা হাতিয়ে নিয়েছে ৮৬ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। এই টাকা সিএসডির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগাভাগি হতো। এমনকি এই টাকার ভাগাভাগি নিয়ে সিএসডিতে মারামারির ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। শনিবার সকালেও টাকার ভাগাভাগি নিয়ে সিএসডিতে মারামারি হয়েছে।
র্যা বের অভিযানের সময় সিএসডির সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ম্যানেজার হুমায়ুন কবির তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তাকে কোনো প্রশ্ন করা হলেই তিনি জানান, তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে যে কোনো শাস্তি মেনে নেবেন।

র্যা বের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ওএমএস’র খাদ্যশস্য পাচারের সঙ্গে শুধু সিএসডির কর্মকর্তা-কর্মচারীই নন, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের অনেকেই জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে রাতের আঁধারে সিএসডি থেকে চাল ও আটা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যাচ্ছে।
অনেক কর্মকর্তাই বিষয়টি জানেন। তবুও নির্বিঘ্নে চলছিল এই কাজ। দুই মাস ধরে চক্রটি আরও বেপরোয়া হয়ে ওএমএস’র চাল পাচার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে র্যা ব বলছে, পাচারে সহায়তাকারী সিন্ডিকেটে কয়েকজন শ্রমিক নেতাও রয়েছেন। তারা হলেন- আলমগীর সৈকত, দুদু, লোকমান ও বিল্লাল। সিএসডির ম্যানেজারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে তারা দীর্ঘদিন ধরে পাচারের মাল লোড করে আসছে।

মোহাম্মদপুরের অভিযানের ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি : মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে রোববার ভোর থেকে দুপর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে র্যা ব। অভিযানে গিয়ে র্যা ব দেখতে পায়, সরকারি খাদ্যগুদামের লোগো এবং সিল সংবলিত চাল এবং আটার বস্তা বিভিন্ন আড়তে রাখা আছে।
অভিযানে কৃষি মার্কেটের ১১ দোকান থেকে ১০০ টন চাল ও আটা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সোমবার রাত ৯টার দিকে মোহাম্মদপুর থানায় ১১ প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে র্যা ব। জানা গেছে, এই মামলার আসামি করার জন্য একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করা হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/89109