১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, সোমবার, ৯:৩১

বেসরকারি চিকিৎসাসেবায় নৈরাজ্য

বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় দেশজুড়ে চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে। বেসরকারি চিকিৎসাসেবা এখন উচ্চ মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা। আর এই ব্যবসা রাজধানীর চেয়ে ঢাকার বাইরে বেশি রমরমা। মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে জিম্মি রোগীরা। ঢাকার বাইরে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রয়েছে অনিয়মের পাহাড়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ ব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণের প্রায় বাইরে চলে গেছে। চলতি বছরে টিআইবি’র (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) প্রকাশিত এক গবেষণায় এমন চিত্র দেখা যায়।

সারা দেশের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর অনিয়ম চরমে উঠেছে।
পুরো ব্যবস্থায় এখন চলছে মালিক, চিকিৎসকের স্বেচ্ছাচার ও চিকিৎসা সেবার নামে প্রতারণা। স্বাস্থ্যসেবা এখন একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের স্বাস্থ্যসেবা। খোদ রাজধানী থেকে শুরু করে মফস্বল শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য বেসরকারি ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। এসব হাসপাতালে নেই বিদ্যমান আইনের কোনো প্রয়োগ। মালিক, চিকিৎসকদের ইচ্ছাই স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনার আইন। তারা ‘মেডিকেল প্র্যাকটিস, প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’ না মেনে রোগীদের থেকে ইচ্ছামতো ফি আদায় করছেন। অথচ রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। দেশজুড়ে গজিয়ে উঠা সরকার অনুমোদিত ও অননুমোদিত অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অধিক ব্যয়সাপেক্ষ এসব বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ তেমন সেবা পাচ্ছে না। বরং সেবার নামে অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অধিক অর্থ আদায়, প্রতারণা, ভুল চিকিৎসা এবং জবাবদিহি ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। চিকিৎসা ফি, বেড ও কেবিন ভাড়া, অপারেশন, প্যাথলজি টেস্টের ফি ইত্যাদিও প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করছে। নতুন প্রযুক্তি, আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপনা খরচের নামে তারা চিকিৎসার খরচ বাড়াচ্ছেন। তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে জিম্মি রোগীরা। তাদের ব্যবসায়িক নির্মম মানসিকতার বলি হয়ে অনেকে নিঃস্ব হচ্ছেন, অনেকে ভুল চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। একই চিকিৎসার ফি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ভেদে ভিন্ন। সরকারি নীতিমালার তুলনায় ফি কোথাও শতগুণ বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ব্যর্থতার কারণে দেশের শতকরা ৬৮ ভাগ লোক বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নেন। এ সুযোগসহ সরকারের অদক্ষতা, অবহেলা, উদাসীনতার সুযোগে মালিকরা চালাচ্ছেন স্বেচ্ছাচারিতা। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের স্বাস্থ্যসেবা করার নামেই সরকারের অনুমোদন নেয়। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা চিকিৎসা সামগ্রী, ওষুধ আমদানিতে সরকারি ভর্তুকিও পেয়ে থাকে। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হচ্ছে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। রোগী ভর্তি ফি, শয্যার ভাড়া একেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একেক রকম। এখানে সরকারি নীতিমালা অবহেলিত। মালিকের ইচ্ছেমতো তা আদায় চলছে। দেশের অধিকাংশ বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রই নামসর্বস্ব। সেগুলোতে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ, অস্ত্রোপচার কক্ষ (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত), চিকিৎসার জরুরি যন্ত্রপাতি, ওষুধ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ইত্যাদি নেই।

গত বছর সেপ্টেম্বরে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে খাদ্যনালির অপারেশ করান জেসমিন। এতে তার ব্যয় হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। এই একই অপারেশন সরকারি হাসপাতালে খরচ হয় ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। জেসমিন অভিযোগ করেন, বেসকারি হাসপাতালে কয়েকগুণ বেশি টাকা নিয়েছে। সরকারি হাসপাতালে অপারেশনের তারিখ নিয়ে হয়রানি করায় উপায় না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়েছি। এখানে বাণিজ্যিক মনোভাব নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছে।

টিআইবি’র গবেষণায় বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণহীন ও নিম্নমানের বেসরকারি চিকিৎসা সেবায় আর্থিক ও স্বাস্থ্যজনিত ক্ষতির শিকার হচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা। কমিশন ব্যবসা ও বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধের মাধ্যমে সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। বেসরকারি চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়নসহ এ খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে টিআইবি ১৬টি সুপারিশও পেশ করে। বেসরকারি সাস্থ্যসেবা খাত নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করা হয় সুপারিশে। স্বাধীন কমিশন গঠন ছাড়াও টিআইবির অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করে আইন হিসেবে প্রণয়ন করা এবং নিয়ন্ত্রণ ও পরিদর্শন কার্যক্রম জোরদার করার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তার অভাব, পরিদর্শন ও তদারকির ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি এবং অতি-মুনাফাভিত্তিক প্রকট বাণিজ্যিকীকরণের সম্মিলিত প্রভাবে বেসরকারি চিকিৎসাসেবা খাত কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। রাজধানী ঢাকার বাইরে বেসরকারি ব্যক্তি মালিকানাধীন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনিয়ম সবচেয়ে বেশি। গবেষণাটি জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০১৭ সময়ের মধ্যে পরিচালিত হয়। বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ঢাকা মহানগরীর ২৬টি ও ঢাকার বাইরে আট বিভাগের ৯০টি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ১১৬টি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান থেকে গবেষণার তথ্য সংগৃহীত হয়। এর মধ্যে ৬৬টি হাসপাতাল এবং ৫০টি রোগ-নির্ণয় কেন্দ্র। এই গবেষণায় বেসরকারি চিকিৎসাসেবা বলতে ব্যক্তি মালিকানাধীন নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং রোগ-নির্ণয় কেন্দ্র প্রদত্ত সেবাকে বোঝানো হয়েছে। আইনি সীমাবদ্ধতা, বিদ্যমান যে আইন রয়েছে তা বর্তমান ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে হালনাগাদ না হওয়া, আইন ও নীতির প্রয়োজনীয় প্রয়োগ না হওয়া এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ, পরিদর্শন ও তদারকি কার্যক্রমে ঘাটতিসহ সরকারের যথাযথ মনোযোগের ঘাটতির কারণে বেসরকারি চিকিৎসাসেবা খাত নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে।

এর ফলে অতি-মুনাফাভিত্তিক বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেবার অতিরিক্ত মূল্য আদায়সহ কিছু ব্যক্তির এ খাত থেকে বিধিবহির্ভূত সুযোগ-সুবিধা আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সক্ষমতার ঘাটতি ও অনিয়মের প্রবণতা অধিকতর লক্ষণীয়। অবকাঠামো, জনবল ও যন্ত্রপাতির ঘাটতিসহ সার্বিক সক্ষমতায় ঘাটতি থাকায় সেবাগ্রহীতারা সঠিক ও মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক ও স্বাস্থ্যগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দেশের চিকিৎসাসেবার প্রতি আস্থা হারিয়ে সেবাগ্রহীতাদের বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গবেষণার পর্যবেক্ষণে বলা হয়, নিবন্ধন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন হচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠানের অবস্থান, মালিক বা অংশীদারদের প্রভাব-প্রতিপত্তির ওপর এ অর্থের পরিমাণ নির্ভর করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিদর্শনের তারিখ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে আগেই জানিয়ে দেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান ওই নির্দিষ্ট দিনের জন্য জনবল ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র সঠিক রাখে। কিছু ক্ষেত্রে নবায়নের সকল শর্ত পালনে ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও সর্বনিম্ন পাঁচ শ’ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের মাধ্যমে নিবন্ধন নবায়নের সুযোগ প্রদান করা হচ্ছে। অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর ঘটনায় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ করার কোনো আইন নেই। বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগ-নির্ণয় কেন্দ্র নিবন্ধিত না হয়েই কার্যক্রম শুরু করে এবং দেশব্যাপী কতগুলো অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার কোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। অধিক মুনাফা অর্জনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনেক সময় প্রসূতিকে সিজারিয়ান প্রসবে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগ রয়েছে।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উচ্চ মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা হিসেবে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা খাত বিকাশ হচ্ছে। এখানে তদারকির অভাব রয়েছে। সাধারণ মানুষ চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছে। এজন্য এই বেসরকারি সাস্থ্যসেবা খাত নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা দরকার। মান নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না। জনগণ প্রতারিত হচ্ছে। এর থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই

http://mzamin.com/article.php?mzamin=134784