১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, সোমবার, ৯:২০

২শ’ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিলীন

পদ্মার অব্যাহত ভাঙনে এক সপ্তাহে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার দুটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার অন্তত ২৫০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে গেছে। এই সময়ে ৪ শতাধিক বাড়িঘরসহ বড় বড় স্থাপনা নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা ভাঙছে। মাঝেমধ্যেই তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ২ মাসে প্রায় ৪ হাজার পরিবার সব হারিয়ে পথে বসে গেছে। তারা এখন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অথচ কিছুদিন আগেও তাদের সবই ছিল। গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গরু-বাছুর, ফসলি জমি সবই ছিল। কিছুদিনের ব্যবধানে এই মানুষগুলো এখন পথের ফকির।

ভাঙনের ঝুঁকিতে মুলফৎগঞ্জ বাজারের ৮ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিও সর্বনাশা পদ্মার করাল গ্রাসে বিলীন হওয়ার পথে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি, ভাঙন রোধে তারা ৫ কোটি টাকার জিওব্যাগ ফেলেছে; কিন্তু ভাঙন থামানো যায়নি। পথে বসা এই অসহায় মানুষগুলোকে সান্ত্বনা দেয়ারও যেন কেউ নেই। ভাঙনকবলিত এলাকায় দেখা যায়নি কোনো সরকারি বা জনপ্রতিনিধিকে। অবিলম্বে বেড়িবাঁধ দিয়ে বাকি এলাকা রক্ষার জোর দাবি স্থানীয়দের।
চরজুজিরা, মুলফৎগঞ্জ ও নড়িয়া ভাঙনকবলিত এলাকা ঘুরে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নড়িয়া উপজেলার মুক্তারের চর, কেদারপুর ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌরসভার বিস্তীর্ণ এলাকা এখন নদীগর্ভে। বিশেষ করে ২ মাসে পদ্মা হিংস রূপ ধারণ করেছে। ৭ দিন ধরে নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জ, ওয়াদা বাজার, সাধুর বাজারের ২০০-২৫০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে চলে গেছে। ২০০ বছরের পুরনো মূলফৎগঞ্জ বাজারের বড় একটি অংশ হারিয়ে গেছে নদীতে। এছাড়া বহু বাড়িঘর ও বড় বড় স্থাপনা, রাস্তা, সেতু, কালভার্ট নদীগর্ভে চলে গেছে। কয়েক হাজার একর আবাদি জমির চিহ্ন মুছে গেছে। অনেক পরিবার আতঙ্কে ঘরবাড়ি ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে।
ভাঙনের ঝুঁকি রয়েছে ৮০০ দোকান এবং মুলফৎগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসাসহ শত শত পাকা-আধাপাকা বাড়িঘর ও সরকারি প্রতিষ্ঠান। ভাঙতে ভাঙতে পদ্মানদী এখন নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাছে চলে এসেছে। শনিবার রাতে হাসপাতালের মসজিদের একাংশ গ্রাস করে নিয়েছে নদী। হাসপাতালের নতুন ভবনেও ফাটল দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে হাসপাতালের মালামাল সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ভর্তি রোগীরা হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে যার যার মতো চলে গেছেন। হাসপাতালটিও পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। প্রাচীন এ হাসপাতালটি এখন নদীগর্ভে বিলীনের অপেক্ষায়।

ঘরবাড়ি ও ফসলি জামি হারিয়ে অনেকেই এখন খোলা প্রান্তরে জায়গা নিয়েছে। বাপ-দাদার ভিটেমাটি. সহায়-সম্বল হারিয়ে তারা এখন মাথা গোজার ঠাঁই খুঁজছে। পদ্মার তীরে দাঁড়িয়ে অনেককেই নীরবে চোখে পানি ফেলতে দেখা যায়। নীরবতা ভেঙে অনেকে আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠছে।
রোববার দুপুরে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায় ভিন্ন এক পরিবেশ। দুই মাস আগে মুলফৎগঞ্জ বাজার, চরজুজিরগাঁও, দাসপাড়া, উত্তর কেদারপুর এলাকায় ভাঙন শুরু হলেও ১০ দিন ধরে তীব্র আকার ধারণ করেছে। অধিকাংশ পরিবারকেই ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে আসবাবপত্র সরাতে ব্যস্ত দেখা গেল।
এ পর্যন্ত সরকারের ত্রাণ তহবিল থেকে কিছু শুকনো খাবার, সাড়ে ৩ হাজার পরিবারকে জিআর চাল, ৩শ পরিবারকে ঢেউটিন দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। নড়িয়া শহর রক্ষা করতে জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধের কাজ শুরু করার দাবি জানিয়েছে। কেদারপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন মাল নির্বাচনের পর থেকেই বিদেশে অবস্থান করছেন। দায়িত্বে রয়েছেন মেম্বার হাফেজ ছানা উল্লাহ মিয়া। মুঠোফোনে তিনি বলেন, অনেক দূরে আছি ভাই। এ নিয়ে কোনো কথা বলতে পারবো না।

নড়িয়া হাসপাতালের স্টাফ নার্স রোজিনা আকতার বলেন, নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের কার্যক্রম আবাসিক ভবনে পরিচালানা করা হচ্ছে, দুটি মূল ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। যে কোনো সময় হাসপতালটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। শুক্রবার রাতে হাসপাতাল মসজিদের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। নুতন ভবনেও ফাটল দেখা দিয়েছে। সব হারিয়ে চরজুজিরা গ্রামের খোকন খান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, পদ্মা আমার দোকান, বাড়িঘর, জমিজমা কেড়ে নিয়েছে। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছি। ভাঙনরোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
ডা. মো. গোলাম ফারুক বলেন, পদ্মানদী এখন নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গেটে। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নড়িয়া উপজেলার মানুষ। জরুরি ভিত্তিতে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কেদারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ক্ষতিগ্রস্থ ঈমাম হোসেন দেওয়ান বলেন, গত কয়েক দিনে ৩শ’ বছরের পুরনো মুলফৎগঞ্জ বাজারের কয়েকটি ক্লিনিক, শপিংমলসহ প্রায় ২৫০ দোকান নদীগর্ভে চলে গেছে। আমাদের দেখার কেউ নেই। সান্ত্বনা দেয়ার জন্য কাউকে দেখা যায়নি। এলাকাটি দুর্যোগপ্রবণ ঘোষণা করা হোক। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।
কথা হয় নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, পদ্মার ভাঙনে প্রায় ৪ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। সাধুর বাজার ও ওয়াপদা বাজারের ২ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মুলফৎগঞ্জ বাজারের ২ শতাধিক দোকানপাট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে জিআর চাল, ঢেউটিন ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সাধুর বাজার এলাকার ২০টি পরিবারের মাঝে ১০ হাজার টাকা করে চেক বিতরণ করেছি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/88753