১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, সোমবার, ৯:০৭

রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগ স্থবির

বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটছে না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে বিনিয়োগে সতর্ক উদ্যোক্তারা। একই সাথে আমানতের সুদ হার কমায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিও কমেছে। গত জুলাই মাস পর্যন্ত এ খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৯ লাখ ১ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। যা জুন মাসের তুলনায় ৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ কম। জুনে ঋণ ছিল ৯ লাখ ৭ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমানতকারি সুদ না পেলে ব্যাংক বিমুখ হয়ে পড়বে।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক সংকট চলছে তার সমাধান কি কেউ জানে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কাদা ছুড়াছুড়ি চলছেই। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। এতে করে সাধারন মানুষ যেমন তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি উদ্যোক্তারা বড় ধরনের বিনিয়োগে যেতে সাহস পাচ্ছে না।

সরকারি উদ্যোগে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প চালু থাকায় আমদানি বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু দৃশ্যমান কোন বিনিয়োগ নেই। সরকারি মেশিনারি আমদানির পাশাপাশি রয়েছে মুদ্রা পাচার। বিষয়টি কেউ শিকার না করলে প্রকৃত অবস্থা তাই ঈঙ্গিত করে। দেশে আমদানি বাড়লে বিনিয়োগ বাড়ে এাঁই স্বাভাবিক সূত্র। কিন্তু এই সরকারের আমলে এই সূত্র কোনভাবেই মিলছে না।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় বিনিয়োগ করতে হলে রাজনৈতিক অনূকূল পরিবেশ লাগে। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন তা যদি গণতান্ত্রিক সরকার হয় তাহলে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু জনগনের রায়ে নির্বাচিত নয় এমন সরকারের অধীনে বড় ধরনের বিনিয়োগ ঝুঁকি। এই ঝুঁকি নিয়ে কেউ বড় ধরনের বিনিয়োগ করার সাহস পাচ্ছে না।

সরকার বার বার বলে আসছে দেশের বিনিয়োগের পরিবেশ রয়েছে। কিন্তু সরকারের এমন আহবানেও ব্যবসায়ীরা বড় বিনিয়োগে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। এতে করে দেশে যেমন বিনিয়োগ স্থিবিরতা অব্যাহত রয়েছে তেমনি বেকারত্বও বাড়ছে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সরকার নানা সুযোগ সুবিধা দিলেও কাজে আসছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমানতের সুদ হার কমে যাওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট, সরকারে নির্দেশনা থাকলেও এক অংক সুদে ঋণ বিতরণে অনাগ্রহ, জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে নতুন বিনিয়োগে ব্যাংক ও গ্রাহকদের সতর্কতা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে সতর্কতাসহ বিভিন্ন কারণে ঋণ বিতরণ কমেছে।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া এডিআর (ঋণ-আমানত অনুপাত) বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে চলছে ব্যাংকগুলো। এ কারণে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে ঘোষিত প্রাক্কলনের চেয়ে প্রায় ১ শতাংশ কম। মুদ্রানীতিতে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ।
এর আগের মুদ্রানীতিতে একই রকম প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হলেও গত জুনে প্রবৃদ্ধি হয় ১৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে কখনও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশের নিচে নামেনি। এমনকি নভেম্বরে তা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ওই সময় সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।মূলত ৩টি কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

তিনি বলেন, সামনে নির্বাচন, তাই ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে কিছুটা সচেতন। আগামী মার্চের মধ্যে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর এডিআর কমিয়ে ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর ৮৯ শতাংশে নামিয়ে আনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণ করছে।
আমানতে ৬ শতাংশ এবং ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণের প্রভাবও পড়েছে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে। এসব কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে ধীরে চল নীতিতে চলছে।

মাহবুবের সাথে প্রায় একমত পোষণ করেন অগ্রণী ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইউসুফ আলী।
তিনি বলেন, আমার জানামতে ব্যাংকগুলো এখন ঋণ বিতরণে খুব সতর্ক। কারণ সামনে নির্বাচন। অনেকেই ঋণের জন্য আবেদন করে। গ্রাহকের বিস্তারিত তথ্য যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া আমানতের সুদ হার কমে যাওয়ার প্রভাবও হয়তো পড়েছে। তাই ঋণ প্রবৃদ্ধি সামান্য কমেছে। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই ঋণ বিতরণ বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
তবে নির্বাচন উপলক্ষে নয় বরং আমানতের সুদ হারে লাগাম টানায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে বলে মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্বনর ইব্রাহীম খালেদ।
তিনি বলেন, ব্যাংকে এখন আমানতের ওপর সুদ দেয়া হচ্ছে ৬ শতাংশ। যা আগের তুলনা কম। এ সুদ হার কমার কারণে ব্যাংকে আমানত কমেছে। আমানত না আসলে ব্যাংকগুলো ঋণ দিবে কোথায় থেকে। তাই ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমানতের সুদ হার কমে যাওয়ায় মানুষ আমানত না রেখে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। তাই ব্যাংকগুলো আমানতে সংকটে রয়েছে। সেজন্য ঋণ বিতরণও কমেছে।
বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে গেল অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যেহেতু আমানতে সুদ হার কমেছে, এখন সঞ্চয়পত্রেও সুদ হার কমাতে হবে। এতে মানুষ আমানতমুখী হবে। ঋণ প্রবাহও বাড়বে।

দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে ঋণের সুদ হার এক অংকে আনতে বার বার তাগিদ দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। অবশেষে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির পক্ষ থেকে ১ জুলাই থেকে এক অংকে সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর অর্থমন্ত্রী ২ আগস্ট সব ব্যাংকের মালিকদের সাথে বৈঠক করে ৯ আগস্ট থেকে এক অংক সুদে ঋণ বিতরণের নির্দেশ দেন।
তবে তা মানেনি অধিকাংশ ব্যাংক। তাদের যুক্তি, ৯ শতাংশের বেশি সুদে মেয়াদি আমানত নিয়ে এক অংকে সুদে ঋণ বিতরণ সম্ভব নয়। সেজন্য লোকসান থেকে বাঁচতে অনেক ব্যাংক নতুন করে আর ঋণ দিচ্ছে না।

http://www.dailysangram.com/post/344913