৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৫৭

ঋণখেলাপি আর খেলাপি ঋণ দুটোই বাড়ছে

খেলাপি ২৩০৬৫৮ জন, ঋণ ১৩১৬৬৬ কোটি টাকা

দেশে বাড়ছে ঋণখেলাপির সংখ্যা। সেই সাথে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুন শেষে ঋণখেলাপির সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮ জন। তাদের কাছে পাওনা হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। তবে অতীতে শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় ছিল এমন বড় বড় শিল্প গ্রুপের নাম নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এ তালিকায়। বিশেষ বিবেচনায় এসব শিল্পগ্রুপের অনিয়মিত ঋণকে নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। এ জন্য খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তালিকায় শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির মধ্যে প্রথম দশে রয়েছে মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্স, কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেম লিমিটেড, রিমিক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড, ম্যাক্স স্পিনিং মিলস, রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, রাইজিং স্টিল লিমিটেড, ঢাকা ট্রেডিং হাউজ, বেনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আনোয়ার স্পিনিং মিলস এবং ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ, বিপরীতে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৮ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। অবলোপনসহ যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেখানো হয়েছে তা হলো মোট ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা ঋণের ১৫ শতাংশ। আর মোট ৯ লাখ ৬৮ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা আমানতের ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে খেলাপি ঋণের যে চিত্র দেখানো হচ্ছে তা প্রকৃত অবস্থা থেকে অনেক কম বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। ওই সূত্র মতে, মাত্র এক ও দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১১টি শিল্প গ্রুপ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছিল। ওই সব ঋণের বেশির ভাগই আদায় হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান মতে, ঋণ আদায় না হওয়ায় বিশেষ সুবিধা নিয়ে নিয়মিত করা ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ এখন বকেয়াসহ ২৬ হাজার কোটি টাকা উঠে গেছে। কিন্তু তাদের কেউ উচ্চ আদালত রিট করে নিয়মিত দেখাচ্ছেন, আবার কেউ বিশেষ সুবিধা নিয়ে বারবার নবায়ন করে তা নিয়মিত দেখাচ্ছেন। ফলে এসব ঋণ আর খেলাপি ঋণের হিসেবে প্রতিফলিত হচ্ছে না।
আবার অতীতে শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় ছিল এমন বড় বড় শিল্প গ্রুপের ঋণ এখন আর খেলাপি ঋণের হিসাবে নেই। বিশেষ সুবিধা নিয়ে ওই সব ঋণ এখন নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। যেমনÑ চট্টগ্রামভিত্তিক একটি বড় শিল্পগ্রুপের কোনো ঋণই এখন খেলাপি নেই। সব ঋণই নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। এভাবে বড় বড় শিল্পগ্রুপের ঋণ নিয়মিত দেখানোর ফলে খেলাপি প্রকৃত চিত্র আসছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, অবস্থা এখন বিষ খেয়ে বিষ হজম করার মতো। অনেক ক্ষেত্রেই এখন নীতিমালা অনুযায়ী ফাইলে মতামত দেয়ার সুযোগ নেই। ওপর থেকে যেভাবে চাওয়া হচ্ছে সেভাবেই ফাইল অনুমোদন করতে হচ্ছে।

অগ্রণী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রায় সবগুলো ব্যাংক থেকেই ঋণ নিয়ে ফাইওভার করেছিল। কিন্তু আইনগত ফাঁকফোকর দেখিয়ে এখন ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করছে না। অথচ ওই গ্রুপের কোনো ঋণই এখন আর খেলাপি দেখানো যাচ্ছে না।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানান, বেশির ভাগ ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়মিতভাবে পরিশোধ করছে। কিন্তু বেশির ভাগ বড় বড় শিল্পগ্রুপ ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না। তারা উচ্চ আদালতে রিট করে নিজের পক্ষে রায় নিয়ে আসছেন। ফলে ঋণখেলাপি হওয়া সত্ত্বেও তাদের ঋণখেলাপি বলা যাচ্ছে না। ঋণখেলাপি হলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। নতুন করে ঋণও নিতে পারেন না। কিন্তু বড় বড় শিল্পগ্রুপগুলো উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে আবার অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। ঋণ পরিশোধ না করায় আবার তা খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে এক একটি শিল্পগ্রুপের বিপরীতে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ জমছে।

এ দিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের আয়ে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। কেননা খেলাপি ঋণভেদে ২৫ শতাংশ থেকে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। ফলে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে মুনাফার একটি বড় অংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই ব্যাংকগুলো তাদের পরিচালন ব্যয় মেটাতে ব্যাংক ঋণের সুদ হার ও উচ্চ সার্ভিস চার্জ কমাতে পারছে না। অপর দিকে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ। এভাবেই ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতির মুখে পড়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ঝুঁকির মাত্রা আরো বেড়ে যাবে, যা অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো ফল বয়ে আনবে না।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/346922