৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৫৫

শিল্প খাতের মধ্যে গার্মেন্ট শ্রমিকের মজুরি সবচেয়ে কম

মুহাম্মদ নূরে আলম : দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১০টি শিল্প খাতের মধ্যে পোশাক শ্রমিকের মজুরিই সবচেয়ে কম, তাদের ন্যূনতম মজুরি মাসে ৫ হাজার ৩০০ টাকা। অথচ পোশাক খাতই দেশের সবচেয়ে ব্যবসাসফল শিল্প খাত। এই শিল্প থেকেই দেশের ৮৩ ভাগ রপ্তানি আয় হয়। বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। আবার কম মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দ্বিতীয়। বাংলাদেশ বিশ্বে পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। অপরদিকে দেশের ট্যানারি শ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৮০০ টাকা। এ ছাড়া জাহাজভাঙা শিল্পে ১৬ হাজার এবং ওষুধশিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার ৫০ টাকা। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানার শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি শতভাগ বৃদ্ধি করে ৮ হাজার ৩০০ টাকা ঘোষণা করেছে সরকার। মজুরির সঙ্গে বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য ভাতা যোগ করলে মাস শেষে বেতন-ভাতা ১৪ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তার মধ্যে গত বছর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ট্যানারি, জাহাজভাঙা, ওষুধ, টি প্যাকেটিং, কটন টেক্সটাইলসহ ৯টি খাতের মজুরি নির্ধারণ করেছে মজুরি বোর্ড। মজুরি বোর্ড সূত্রে এইসব তথ্য জানাযায়।

ন্যূনতম মজুরি বোর্ডে ঘোষিত মজুরি কাঠামো অনুযায়ী, বর্তমানে নির্মাণশিল্প ও কাঠের কাজ করেন এমন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৯ হাজার ৮৮২ টাকা। ট্যানারি শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি ১২ হাজার ৮০০ টাকা । তেল মিলের শ্রমিকের মজুরি সর্বনিম্ন ৭ হাজার ৪২০ টাকা। ব্যক্তি মালিকানাধীন সড়ক পরিবহনে ৬ হাজার ৩০০ টাকা, রি-রোলিং মিলে ৬ হাজার ১০০ টাকা, কোল্ড স্টোরেজে ৬ হাজার ৫০ টাকা, গ্লাস অ্যান্ড সিলিকেটস কারখানায় ৫ হাজার ৩০০ টাকা সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারিত আছে। এমনকি ধান ভাঙানোর চাতালে আধা দক্ষ শ্রমিকের মজুরিও এখন ৭ হাজার ১৪০ টাকা। সল্ট (লবণ) ক্রাশিং শিল্পে মজুরি ঘণ্টায় ২৬৫ টাকা।

ট্যানারি, জাহাজভাঙা ও ওষুধশিল্পের চেয়ে অনেক বড় এবং ব্যবসাসফল খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক। দেশের পণ্য রপ্তানির সাড়ে ৮৩ শতাংশ পোশাক খাত থেকে আসছে। তবে ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলার বা আড়াই লাখ কোটি টাকা রপ্তানি আয়ের এই খাতের শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি উল্লেখযোগ্য অন্য খাতের তুলনায় বেশ কম। নিম্নতম মজুরি বোর্ড দেশের ৪১টি খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করেছে। তার মধ্যে গত বছর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ট্যানারি, জাহাজভাঙা, ওষুধ, টি প্যাকেটিং, কটন টেক্সটাইলসহ ৯টি খাতের মজুরি নির্ধারণ করেছে মজুরি বোর্ড। এর মধ্যে ট্যানারিতে ১২ হাজার ৮০০, জাহাজভাঙায় ১৬ হাজার, ওষুধে ৮ হাজার ৫০, টি প্যাকেটিংয়ে সাড়ে ৮ হাজার, কটন টেক্সটাইলে ৫ হাজার ৭১০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। এমনকি ধান ভাঙানোর চাতালে আধা দক্ষ শ্রমিকের মজুরিও এখন সাত হাজার ১৪০ টাকা। সল্ট (লবণ) ক্রাশিং শিল্পে মজুরি ঘণ্টায় ২৬৫ টাকা। কিন্তু পোশাকশিল্পে মজুরি হচ্ছে মাত্র তিন হাজার টাকা।

বর্তমানে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা। গত জুলাই মাসে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সভায় পোশাকশিল্পের মালিকেরা মজুরি মাত্র ১ হাজার ৬০ টাকা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেন। সব মিলিয়ে তাঁরা মজুরি ৬ হাজার ৩০০ টাকা দিতে চান। অন্যদিকে শ্রমিকপক্ষ ১২ হাজার ২০ টাকা মজুরি দাবি করেছে। শ্রম মন্ত্রণালয় গত ৩১ জানুয়ারি পোশাকশিল্পের মজুরি বোর্ড গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। ১৬ জুলাই তৃতীয় সভায় নিজেদের মজুরি প্রস্তাব দেয় মালিক ও শ্রমিকপক্ষ। কম মজুরির প্রস্তাবের পক্ষে মালিকপক্ষ লিখিত যুক্তি দিয়েছে, প্রতিযোগী অন্য দেশের চেয়ে পোশাকশ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কম দাবি করছে পোশাক শিল্পের মালিকপক্ষ।

উভয় পক্ষের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ১৬ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে মানববন্ধন ও সভা-সমাবেশ করছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহের সোমবার বিকেলে শাহবাগে গার্মেন্ট শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা সমাবেশ করেন।
গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি সম্পর্কে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা বলছে, মালিকপক্ষ যে মজুরি প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানে বড় ধরনের সমন্বয়ের সুযোগ আছে। কারণ, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ৩২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। সেটি বিবেচনায় নিলে মজুরি হয় ৭ হাজার টাকা। আবার শ্রমিকের জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় নিলেও মজুরি অনেক বাড়বে। তাই মালিকপক্ষের নিজেদের প্রস্তাব নতুন করে বিবেচনা করে মজুরি বোর্ডে জমা দেওয়া উচিত। সিপিডির গবেষণা বলছে, ‘বিজিএমইএ পোশাকশ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা ৪০ শতাংশ বললেও আমরা গবেষণায় দেখেছি, উৎপাদনশীলতা ৫০ শতাংশের ওপরে। সেটি ধীরে ধীরে বাড়ছে।’

ট্যানারি, জাহাজভাঙা, ওষুধের মতো তুলনামূলক বড় খাত বিবেচনায় নিলে পোশাক খাতের মজুরি বেশ কম, ৫ হাজার ৩০০ টাকা। মালিকপক্ষ যে ১ হাজার ৬০ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে, সেটি বাস্তবায়িত হলেও কমই থাকবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রমবিশেষজ্ঞ ও শ্রমিকনেতারা বলেন, ‘পোশাকশ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির যে প্রস্তাব মালিকপক্ষ দিয়েছে, সেটি নৈতিক কিংবা আইনি কানোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আবার শ্রমিকপক্ষের প্রস্তাবে শ্রমিকদের সত্যিকার চাহিদার প্রতিফলন হয়নি। তাই নিম্নতম মজুরি বোর্ডের নিরপেক্ষ সদস্যের উচিত শ্রমিকের জীবনযাত্রার ব্যয় হিসাব করে নতুন আরেকটি প্রস্তাব দেওয়া।’

বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক বাংলাদেশ। আবার কম মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দ্বিতীয়। শ্রীলঙ্কার শ্রমিকেরা সবচেয়ে কম মজুরি পান, মাসিক ৬৬ মার্কিন ডলার। তারপর বাংলাদেশে ৬৮ ডলার। শ্রমিকের মজুরি সবচেয়ে বেশি তুরস্কে, ৫১৭ ডলার। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটাই উঠে এসেছে। সেই প্রতিবেদনে শীর্ষ ২০ পোশাক রপ্তানিকারক দেশের শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি উল্লেখ ছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী চীনে ন্যূনতম মজুরি ১৫৫ ডলার, ভিয়েতনামে ১০০, ভারতে ৭৮ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১২৮, পাকিস্তানে ৯৯ ডলার, ফিলিপাইনে ১৫০ ডলার।

বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গত ৩ সেপ্টেম্বর মজুরি বোর্ডের সভা শেষে ঢাকার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আলোচনা করে আমরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি বিধায়, আবার আরেকটি মিটিং দেওয়া হয়েছে। সেই মিটিংয়েই যে হয়ে যাবে সেটাও আমরা বলতে পারছি না। আমরা চেষ্টা করছি সবাই মিলে এমন একটা জায়গায় আসা যায় যাতে শিল্পের সক্ষমতা এবং শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা রক্ষা পায়। সেই চেষ্টাটাই আমরা করে যাচ্ছি। আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলেই ফাইনাল অ্যামাউন্ট (নতুন মজুরি) আমরা আপনাদের জানাতে পারবো।’ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএ সভাপতি আরও বলেন, ‘পূর্বের নিয়ম অনুযায়ীই নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন হবে। আর নতুন মজুরি কাঠামো ডিসেম্বরেই বাস্তবায়ন হবে। এটা কনফার্ম।’
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) করা এক জরিপে প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে সাদামাটা জীবন যাপন করতে চার সদস্যের একটি শ্রমিক পরিবারের মাসে কমপক্ষে ১২ হাজার টাকার প্রয়োজন। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে কোনোরকমে টিকে থাকতে শ্রমিক পরিবারকে খরচ করতে হচ্ছে যথাক্রমে ১৩ হাজার ২৪০, ১৩ হাজার ৪৮১ ও ১১ হাজার ১১১ টাকা।

জরিপে পাওয়া প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় একজন পোশাকশ্রমিকের মাসে কমপক্ষে পাঁচ হাজার ২২ টাকা লাগে। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে দরকার হয় যথাক্রমে চার হাজার ৮৯৮, পাঁচ হাজার ১১৩ ও চার হাজার ৮২৯ টাকা।
জরিপে শ্রমিকদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, কত টাকা হলে তাঁরা মোটামুটিভাবে জীবন যাপন করতে পারবেন। তাঁরা জানিয়েছেন, ঢাকায় চার সদস্যের পরিবারের জন্য প্রয়োজন ১৯ হাজার ৭৩৫ টাকা। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে প্রয়োজন যথাক্রমে ১৯ হাজার ৫৩৫, ২০ হাজার ৩৪ ও ১৮ হাজার ৭০১ টাকা। একইভাবে ঢাকার একজন শ্রমিকের জন্য ১০ হাজর ৭৪৯, গাজীপুরে ৯ হাজার ৮৩৩, নারায়ণগঞ্জে ১১ হাজার ২৩২ ও চট্টগ্রামে নয় হাজার ৬৮৯ টাকা প্রয়োাজন বলে জানিয়েছেন জরিপে অংশ নেওয়া শ্রমিকেরা।

এশিয়ার বিভিন্ন দেশের পোশাকশ্রমিকের মজুরিও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। যদিও এদের মধ্যে চীন ছাড়া সব দেশ থেকেই বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে এগিয়ে আছে। আমেরিকার ওয়ার্কার রাইটস কনসোর্টিয়ামের ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে ২০১১ সাল ভিত্তিক বিভিন্ন দেশের পোশাক শ্রমিকের মাসিক মজুরির হিসাব তুলে ধররা হয়েছে। তাতে বিশ্বের দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকের মজুরি দেখানো হয়েছে ৫২ মার্কিন ডলার। আর বিশ্বের ১ নম্বর রপ্তানিকারক দেশ চীনের মজুরি ২২৩ ডলার। এ ছাড়া কম্বোডিয়া ও ভারতে ৭০ ডলার, ইন্দোনেশিয়াতে ১১৪ ডলার, ভিয়েতনামে ১০৯ ডলার, ফিলিপাইনে ১৭৫ ডলার, থাইল্যান্ডে ২২১ ডলার মজুরি পান পোশাকশ্রমিকেরা।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিয়েতনামের সমাজতান্ত্রিক সরকার শ্রমিকের জন্য খুবই সস্তায় আবাসন, পরিবহন ও অন্যান্য সুবিধাও দিয়ে থাকে। এই দেশটি এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী দেশ।
রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩২ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু আর তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকা-ে ১১২ জন শ্রমিকের প্রাণহানির পর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এখানে ধারাবাহিক শ্রমিক অসন্তোষের মূলে রয়েছে কম মজুরি। এ কারণে গোটা পোশাক খাতের ভবিষ্যৎই ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/344434