৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৪৮

সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

একাদশ সংসদ নির্বাচন নিকটবর্তী হওয়ায় ওই নির্বাচন কীভাবে কেমন সরকারের অধীনে হবে সে বিষয়ে বিতর্ক জমে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা পাঁচ বছর ধরে একই কথা বারবার বলে যাচ্ছেন।
সে বক্তব্য হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলে এখন সংবিধানে কিছু নেই। কাজেই ২০১৪ সালে যেভাবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল, এবারও সেই একই নিয়মে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

নির্বাচনের এ খেলায় বিএনপি যদি মাঠে না নামে, তাহলে তারা গতবারের মতো এবারও ফাঁকা মাঠে গোল দেবেন। সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রীদের এমন বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, রাজনীতিতে লাজলজ্জা বলে কিছু নেই। তাদের মনে রাখতে হবে, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে বিজয়ী হওয়ার মধ্যে লজ্জা থাকতে পারে, কিন্তু বাহাদুরি নেই।
কিন্তু তারা যেভাবে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার কথা বলছেন, তাতে অনেকের মনে হতে পারে, এ কাজটি খুব কৃতিত্বপূর্ণ। ব্যাপারটি তো আসলে তা নয়। সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-মন্ত্রীদের আরও ভেবেচিন্তে কথা বলা দরকার। ভুলে গেলে চলবে না, দলীয় সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব হচ্ছিল না বলেই সব দল মিলে স্বচ্ছ নির্বাচন করার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এ নতুন ব্যবস্থাকে যেভাবে পরিচর্যা করা দরকার ছিল তা না করে দলীয় ফায়দা হাসিলে ব্যবহার করায় ব্যবস্থাটি বিতর্কিত হয়।

সামরিক শাসনামলের অবসান-পরবর্তী নির্বাচিত সরকারপ্রধান হিসেবে খালেদা জিয়া ১৯৯৪ সালে বিতর্কিত মাগুরা উপনির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী সংবিধানে এ ধরনের সরকারের অস্তিত্ব না থাকার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন দিতে চাননি। ওই সময় আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও জামায়াতকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ১৭৩ দিন হরতাল করে বিএনপি সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাধীনে সংসদ নির্বাচন দিতে বাধ্য করে।
তবে খালেদা জিয়া একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠন করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে সাংবিধানিক ভিত্তি দিয়ে বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নেন। বর্তমান সরকারও যখন দেখছে, দলীয় সরকারের অধীনে স্বচ্ছ নির্বাচন করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন সরকারি দল চাইলে জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় খুব সহজে বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের পক্ষে যে কোনো নাম দিয়ে জাতীয় সংসদে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংশোধনী আনা সহজ।

এ সহজ কাজটি করে চলমান সংকট মেটানো সম্ভব। কাজটি বিএনপির জন্য ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে অনেক কঠিন ছিল। কারণ, তখন আওয়ামী লীগ এমপিরা জাতীয় সংসদ থেকে সম্মিলিতভাবে পদত্যাগ করায় সংসদে সংবিধান সংশোধন করার জন্য বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। কিন্তু বর্তমান সরকার সেদিক দিয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। সংসদে সংবিধান সংশোধন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা সরকারি দলের রয়েছে। এখন সদিচ্ছা থাকলে আসন্ন সংসদ অধিবেশনেই তারা এমন একটি সংশোধনী পাস করে সংকটের উত্তরণ ঘটাতে পারে। তবে লক্ষণ দেখে মনে হয় না সরকারের তেমন ইচ্ছা আছে।

উল্লেখ্য, রাজনীতির কিছু অসুখের কারণে সব দল মিলে নির্বাচনী সংস্কৃতির সুস্থতার সাময়িক ওষুধ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। আশা করা হয়েছিল, এ ব্যবস্থাধীনে কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচনী সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কিন্তু মহাজোট সরকার দলীয় ফায়দার জন্য রাজনীতির উল্লিখিত অসুখ নিরাময় না করেই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা এককভাবে বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। ফলে নির্বাচনী ব্যবস্থার শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। একেকটি নির্বাচনে সংঘটিত দুর্নীতির পর পরের নির্বাচনে তার চেয়ে বেশি দুর্নীতি হতে থাকে। কারণ, নির্বাচনে প্রকাশ্যে দুর্নীতি ও ভোট কাটাকাটি করলেও ক্ষমতাসীন দলের লোক হওয়ায় নির্বাচন কমিশন তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেনি। ফলে নির্বাচনে দুর্নীতির ক্রমান্বয় বৃদ্ধি ঘটে, যা দশম সংসদ নির্বাচনে এসে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে।
দশম সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা, ইউপি, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলোতেও এ ধারা অব্যাহত থাকে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী দুর্নীতি কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। ফলে আগামীতে যদি একাদশ সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে ওই নির্বাচনেও যে ব্যাপক দুর্নীতি-কারচুপি হবে সে কথা আগেই বলে দেয়া যায়। তবে নির্বাচনে সব বিরোধী দল অংশগ্রহণ করলে এবং তারা দুর্নীতি-কারচুপিতে বাধা প্রদান করলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে রক্তপাত অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। এমনিতেই প্রহসনের দশম সংসদ নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক বিশ্বে এই সরকার প্রত্যাশিত সম্মান পায়নি। বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে। এমতাবস্থায় ক্ষমতাসীন দল যদি দলীয় সরকারের অধীনে আরেকটি দুর্নীতি-কারচুপির নির্বাচন জিতে সরকার গঠন করে, তাহলে তা যুগপৎ দেশে ও বিদেশে নতুন সরকারের ভাবমূর্তির অধিকতর অবনমন ঘটাবে।

সংবিধান তো নাগরিক কল্যাণের জন্য। এজন্যই একে প্রয়োজনে বারবার সংশোধন করা হয়েছে। কাজেই নৈরাজ্য ও রক্তপাতের আশঙ্কা এড়াতে স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে সরকার বিরোধীদলীয় দাবিতে সাড়া দিয়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নির্বাচনী স্বচ্ছতা সুনিশ্চিত করতে আরেকবার যদি সংবিধান সংশোধন করে, তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। বরং সে কাজটি ভোটারদের মাঝে সরকারি দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করবে। তবে সংবিধান সংশোধন করা তো দূরের কথা, সরকার এ মুহূর্তে বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপ করতেও নারাজ। যুদ্ধের ময়দানেও বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সংলাপ হয়। আর একটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সরকারি দল প্রতিপক্ষ দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করতে পারবে না? এ কেমন গণতন্ত্রে আমরা বাস করছি! এ কেমন যুক্তি! বিবেকবান নাগরিকরা কি এমন একগুঁয়েমিকে সমর্থন করবেন?

সরকার চাইলে এখনও যে কোনো নাম দিয়ে একটি দলনিরপেক্ষ সরকার সৃষ্টি করে ওই সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে। সংসদে একটি সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করে এ কাজ করা সম্ভব। কারণ, সংসদে সরকারি দলের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। নির্বাচনী স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক সুস্থতা ও নির্বাচনী সংস্কৃতির উন্নতির লক্ষ্যে এমন কাজ করলে ভোটারদের মধ্যে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। তারা এমন বিল পাস করার সময় যদি এ ব্যাখ্যা দেয়, আমরা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে দলীয় ব্যবস্থাধীনে স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের এক্সপেরিমেন্ট করে নির্বাচনী স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি, সেজন্য আমরা আবার নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থায় ফিরে যাচ্ছি, তাহলে স্বচ্ছ নির্বাচন করার সরকারি সদিচ্ছা প্রমাণিত হবে। আর এমন কাজ করলে সুনিশ্চিতভাবে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে। আর সরকারি দল যদি ওই বর্ধিত জনপ্রিয়তার সঙ্গে তাদের আমলের উন্নয়নের প্রসঙ্গ যোগ করে জনগণের কাছে ভোট চায়, তাহলে নাগরিক সমাজ সরকারকে আবারও দেশ পরিচালনার জন্য বেছে নিতে পারে। এমন পলিসি গ্রহণ করলে সরকারের বিরুদ্ধে ইভিএমে নির্বাচন করে প্রযুক্তি অসচেতন ভোটারের দেশে ইসিকে করায়ত্ত করে ডিজিটাল কারচুপির আশ্রয় গ্রহণের অভিযোগ উঠবে না। তবে সময় বেশি নেই। এখনই সরকারকে ঠিক করতে হবে তারা কোন পথে যাবে। স্বচ্ছতার পথ, গণতন্ত্রের পথ, নাকি যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকার পথ?

তবে নির্বাচন সামনে রেখে হঠাৎ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে ইসি তড়িঘড়ি করায় নাগরিক সমাজ যুগপৎ সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সন্দেহের চোখে দেখছে। তাদের অনেকে ভাবছেন, সরকার ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালট কাটাকাটি ইত্যাদি বাদ দিয়ে যদি নীরবে-নিঃশব্দে মেশিনের কারিশমা ব্যবহার করে নির্বাচনী বিজয় সুনিশ্চিত করতে পারে, তাহলে আর প্রকাশ্যে দৃশ্যমানভাবে দুর্নীতি-কারচুপি করার দরকার পড়বে না। যেখানে ৩৫তম কমিশন সভায় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের ব্যাপারে সবাই একমত হতে পারেননি, একমত হয়নি রাজনৈতিক দলগুলো, সুশীল সমাজের অধিকাংশ; সেখানে সরকারি দল ও খণ্ডিত ইসি (ইসি কমিশনার জনাব মাহবুব তালুকদার বাদে) মিলে যদি সংসদ নির্বাচনে ইভিএমকে হ্যাকপ্রুফ না করে নির্বাচনে এক্সপেরিমেন্ট করার নামে আংশিক ব্যবহার করতে পারে তাহলে আর তাদের পায় কে!

প্রতিবেশী ভারত ২২ বছর এক্সপেরিমেন্ট করার পর সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে দুর্নীতি-কারচুপির বিতর্ক এড়াতে পারেনি। বিরোধী কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সম্প্রতি কাগজের ব্যালটে সংসদ নির্বাচনের জোরালো দাবি জানিয়েছেন। আর আমাদের মতো প্রযুক্তি-অসচেতন ভোটারের দেশে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) চালু না করে সংসদ নির্বাচনের অব্যবহিত আগে এক্সপেরিমেন্টের নামে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে নাগরিক সমাজ ডিজিটাল দুর্নীতির আশঙ্কা দেখছেন। তারা ভাবছেন, কমিশন যেখানে সম্মানিত ও সুশিক্ষিত ইসি কমিশনারদের সবাইকে এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, সেখানে জনগণের সন্দেহ তো বাড়বেই। এসব ব্যাপারে চুপ থাকলে জনগণের কাছে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিরোধীদলীয় দাবি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/87655