৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:৩২

ইভিএম প্রকল্পের প্রস্তাব আর বাস্তবতায় বিস্তর ফারাক

নানা সমালোচনার পর আবারো আলোচনায় এসেছে ইভিএম। সম্প্রতি নির্বাচনে ডিজিটাল এই ভোটিং মেশিনটি ব্যবহারের জন্য ‘নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ক্রয়, সংরক্ষণ ও ব্যবহার’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু প্রকল্প প্রস্তাব ও বাস্তবতায় রয়েছে বিস্তর ফারাক। ২০০৯ সালে বুয়েট থেকে মাত্র ১০ হাজার টাকায় কেনা ইভিএমের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ টাকা। বর্তমানে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও যার দাম সাড়ে ১০ হাজার টাকা। ফলে পিইসির সভায় প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে মর্মে মতামত এসেছে।

প্রকল্পের ডিপিপি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৩ হাজার ৮২১ কোটি ৪০ লাখ ৬০ হাজার টাকার প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬টি খাতে। এর মধ্যে তিন হাজার ৫১৫ কোটি ৬০ লাখ ৫০ হাজার টাকা (৯১.৮১) শতাংশ ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয়ের জন্য। প্রতিটি ইভিএম মেশিনের ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ টাকা। যদিও প্রথমপর্যায়ে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ১১ হাজার ৫৫৬ টাকা দরে ১৩০ ইউনিট ইভিএম সংগ্রহ করেছিল ইসি। দ্বিতীয় ধাপে একই প্রতিষ্ঠান থেকে ৩২ হাজার ৫৪৭ টাকা দরে ৪০০টি ও তৃতীয় পর্যায়ে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) থেকে ৪৬ হাজার ৫০১ টাকা দরে ৭০০টি সব মিলিয়ে ১ হাজার ২৩০ ইউনিট ক্রয় করা হয়েছিল। আর বর্তমানে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নির্বাচন কমিশন সাড়ে ১০ হাজার টাকায় ইভিএম ক্রয় করে।
প্রকল্পের আসবাবপত্র ক্রয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে একটি নরমাল চেয়ারের মূল্য ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। আর এক্সিকিউটিভ চেয়ারের ক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে ৪০ হাজার টাকা।

এ রকম প্রায় ২০ ধরনের আসবাবপত্র ক্রয়ের প্রস্তাব উচ্চমূল্যে করা হয়েছে। রাজধানীর ফার্নিচারের শোরুমে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক্সিকিউটিভ চেয়ার বিভিন্ন ধরনের আছে। শোরুমগুলোতে সাধারণ চেয়ারের মূল্য এক থেকে তিন হাজারের মধ্যে। আর এক্সিকিউটিভ চেয়ারের মূল্য দশ থেকে বিশ হাজারের মধ্যে। দেশের নামকরা ফার্নিচারের শোরুম হাতিলে ঘুরে ১৮ হাজার টাকার ওপরে কোনো এক্সিকিউটিভ চেয়ার পাওয়া যায়নি। এক্সিকিউটিভ টেবিলের মূল্য সর্বোচ্চ পাওয়া গেছে ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া ৫ হাজার টাকার ওপরে কোনো সাইড টেবিল ফার্নিচারের শোরুমে পাওয়া যায়নি।
বাজারে দুই টনের এসি ৭০ থেকে ৯০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া গেলেও প্রকল্পে ধরা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। প্রতিটি জিপ গাড়ির মূল্য ধরা হয়েছে ৭১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। মাইক্রোবাসের দর ধরা হয়েছে ৪৭ লাখ টাকা। ৪ লাখ টাকা মূল্য ধরা হয়েছে প্রতিটি ফটোকপি মেশিনের দর।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আলোচনার তাগিদ দিয়েছে পিইসি। প্রকল্পে ২০৪ জন পরামর্শকের প্রয়োজনীয়তা জানতে চেয়েছে পিইসি। এ ক্ষেত্রে পরামর্শকের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও কর্মপরিধি ডিপিপিতে উল্লেখের জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়া ৩০ জনকে বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রদানের কথা বলা হলেও তাদের পরিচয় জানানো হয়নি। প্রকল্পে বিজ্ঞাপন প্রচার, পরিবহন, মোটর যানবাহন ক্রয়, কম্পিউটার সফটওয়্যার, আসবাবপত্র ক্রয় বাবদ বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব কার্যক্রম মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করে। এটাকে অর্থের অপচয় এবং একই সঙ্গে বিলাসিতা বলা যেতে পারে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, পিইসির মূল্যায়ন কমিটির মতামতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালানো হয়েছে কি না সে সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। এর জবাবে ডিপিপিতে বলা হয়েছে, এ প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়নের আগে কোনো সম্ভাব্যতা সমীক্ষা বা প্রাক-বিনিয়োগ সমীক্ষা করা হয়নি। তবে অত্যাধুনিক ও নির্ভরযোগ্য ইভিএম প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দক্ষ ও আইটি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে উপদেষ্টা করে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। এই কারিগরি কমিটির পরামর্শ ও নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) নতুন কনফিগারেশনের উন্নত মানের ইভিএম প্রস্তুত করে।

জানা গেছে, ইসির এ প্রকল্পে ছয়টি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে। এতে দেড় লাখ ইভিএম মেশিন ক্রয়, ভোটারদের মধ্যে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিণ ও দতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এসব মেশিন বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে ব্যবহার করা হবে বলেও প্রকল্পের ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকল্পটি ৫ বছর মেয়াদে (জুলাই ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের জুন) বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্যÑ দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ফল প্রকাশ ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় আস্থা ফেরানো।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রতি ইউনিট ইভিএমের দর প্রথমে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে তা কমিয়ে প্রায় দুই লাখ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। সর্বশেষ কমিশন যে ১৯০ সেট ইভিএম সংগ্রহ করেছে তার দর পড়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার ৯৭৫ টাকা। যদিও প্রকল্পে প্রস্তাবিত ইভিএমের দর ড. হুদা কমিশনের কেনা ইভিএমের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও ইভিএম ব্যবহারে তাড়াহুড়া না করার পরামর্শ দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পের অধীনে দেড় লাখ ইভিএম কেনার পরিকল্পনা করছে ইসি। এজন্য জাতীয় নির্বাচনের চার মাসেরও কম সময় সামনে রেখে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়। ইভিএম যুক্ত করে আরপিও সংশোধনে উঠেপড়ে লাগে ইসি। ৩০ আগস্ট কমিশন সভায় আরপিও সংশোধনের বিরোধিতা করে নোট অব ডিসেন্ট দেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। কমিশন সভাও বর্জন করেন তিনি। পরে অন্য কমিশনারদের সম্মতির ভিত্তিতে আরপিওর খসড়া ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/346623