ছবি : কালের কণ্ঠ
৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:১৫

চট্টগ্রামে হঠাৎ উধাও গণপরিবহন

দিনভর অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার যাত্রীরা

নগরীর লালখান-বাজার মোড়ে আমিন সেন্টারের সামনের সড়কে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৬টার দিকে ৫৫-৬০ জন নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিল গণপরিবহনের অপেক্ষায়। সড়কের বিপরীত দিকে দুই পাশে আরো ২০-২৫ জন করে অপেক্ষা করছিল গাড়ির জন্য। কিন্তু গণপরিবহনের দেখা মিলছিল না। প্রায় ১০ মিনিট পর টাইগারপাসের দিক থেকে বহদ্দারহাটগামী একটি বাস এলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে অপেক্ষারত যাত্রীরা। ঠাসাঠাসি করে চার-পাঁচজন উঠতেই বাসটি ছেড়ে দেয়। পাঁচ মিনিট পর একটি হিউম্যান হলার এলেও সেটি থেকে কেউ নামেনি। গাড়িটিতে ছিল যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। হেলপারের পাশে দাঁড়িয়েও ছিল কয়েকজন।

লালখানবাজার মোড়ে গণপরিবহনের জন্য অপেক্ষারত মানুষের অপেক্ষা আর ফুরায় না। একপর্যায়ে সৈয়দ আহমদ নামের এক ব্যক্তি অন্য একজনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আজকে (মঙ্গলবার) তো বৃহস্পতিবার না, গাড়ি কম কেন? ৩০-৪০ মিনিট দাঁড়িয়ে আছি। বাসায় যাব কিভাবে?’ তখন ফরহাদ উদ্দিন নামের অন্যজন বলেন, ‘সিএনজি অটোরিকশাও তো খালি আসছে না। চলেন, এখানে মানুষ বেশি, একটু হেঁটে ওয়াসার মোড় যাই। সেখান থেকে উঠব গাড়িতে।’

ওই সময় পরিচয় পেয়ে ওই দুজন কালের কণ্ঠকে বলেন, টাইগারপাস মোড়ে তাঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন বাসের জন্য। সেখানে গাড়িতে উঠতে না পেরে কথা বলতে বলতে এসেছেন লালখানবাজার মোড়ে। কিন্তু লালখানবাজার মোড়ে আরো বেশি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির জন্য। একজন বলেন, ‘আমরা যাব পুরাতন চান্দগাঁ পেট্রল পাম্প এলাকায়। টাইগারপাস এলাকায় বাস-মিনিবাস না পেয়ে সিএনজি অটোরিকশা দেখছিলাম। কিন্তু ১২০-১৩০ টাকার ভাড়া চাইছে আড়াই শ টাকা।’ ওই সময় রফিক নামের এক যুবক বলেন, ‘আজকে সকাল থেকে গাড়ি কম। আমি মুরাদপুর থেকে ইস্পাহানি মোড় আসার জন্য অনেক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। পরে রিকশা নিয়ে এসেছি। শুনছি, মামলা-জরিমানার ভয়ে নাকি মালিক-চালকরা গাড়ি কম নামাচ্ছে।’

এর আগে দুপুর ১২টার দিকে ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকায় বিপ্লব উদ্যানের সামনে সড়কেও অনেক মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় গণপরিবহনের জন্য। ওই মোড়ের আটটি পয়েন্টে বিভিন্ন রুটের গাড়িতে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকলেও তারা গাড়ি পাচ্ছিল না। মাঝেমধ্যে দু-একটি গাড়ি এলেও তাতে এতটুকু ঠাঁই নেই। একসময় বিপ্লব উদ্যোনের সামনে ট্রাফিক সিগন্যালের কারণে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। তখন ওই দুই পয়েন্টে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা সেখানে গিয়ে দেখতে পায় সব গাড়ি কানায় কানায় পূর্ণ। যাত্রী ওঠার সুযোগ নেই। একপর্যায়ে সেখানে ৩ নম্বর সড়কে চলাচলকারী একটি মিনিবাস খালি দেখা যায়। দুই নারী তাতে উঠতে চাইলে চালক তাঁর হেলপারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘গেট বন্ধ করোনি কেন?’ সঙ্গে সঙ্গে হেলপার দরজা বন্ধ করে দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চালক বলেন, ‘মালিক বলেছেন কয়েক দিন গাড়ি না চালাতে। সড়কে গরম চলছে। মামলা-জরিমানা হচ্ছে। তাই গাড়ি গ্যারেজে নিয়ে যাচ্ছি। চালাব না।’
গতকাল হঠাৎ করে চট্টগ্রাম নগরীতে গণপরিবহন কমে যায়। সকাল থেকে গাড়ি কম ছিল। দুপুরের পর গাড়ি আরো কমতে শুরু করে। বিকেলে অনেক সড়ক ফাঁকা হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর সংকট আরো চরম আকার ধারণ করে। পূর্ব কোনো কর্মসূচি ও ঘোষণা ছাড়াই গণপরিবহন বন্ধ করার কারণে গতকাল দিনভর অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে যাত্রীদের।

চট্টগ্রাম মহানগরের সবচেয়ে বেশি গণপরিবহন চলাচল করে ১০ নম্বর সড়কে। কালুরঘাট থেকে সি-বিচ পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার সড়কে ২৫০ বাস-মিনিবাসের পারমিট রয়েছে। আরো প্রায় দেড় শ বাস-মিনিবাস চলাচল করে অবৈধভাবে। এ ছাড়া হিউম্যান হলার চলাচল করে শতাধিক। লাভজনক হওয়ায় প্রধান এই সড়কে বৈধ-অবৈধ মিলে পাঁচ শতাধিক বাস, মিনিবাস ও হিউম্যান হলার চলাচল করে আসছে। গতকাল ওই সড়কে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। মোড়ে মোড়ে গণপরিবহনের অভাবে যাত্রীরা সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর রাস্তায় হঠাৎ গণপরিবহন সংকটের প্রধান কারণ কড়াকড়ি। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশসহ প্রশাসন মাঠে নেমেছে। গত কয়েক দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে প্রশাসন। দুই দিন ধরে চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের নেতারাও নেমেছেন সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। তবে মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের নেতারা নামেননি।

কড়াকড়ির কারণে গতকাল নগরীর রাস্তায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ গণপরিবহন নামেনি। তবে বিভিন্ন পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, ৪০ শতাংশের মতো গাড়ি সড়কে নামেনি। এর জন্য তাঁরা ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের পাশাপাশি বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশকেও দায়ী করেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশাসনের হয়রানির কারণ এবং মামলা-জরিমানা থেকে রক্ষা পেতে অনেকে গাড়ি নামায়নি।
গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর প্রবেশপথ সিটি গেট এলাকায় জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণসহ ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ এবং লাইসেন্সবিহীন চালক ঠেকাতে মাঠে নেমেছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাদের এই কার্যক্রমে ট্রাফিক পুলিশ ও বিআরটিএর কর্মকর্তারা অংশ নেন। এ ছাড়া গতকাল নগরীর বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক বিভাগ ও বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে।

চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সহসভাপতি মাহবুব হক মিয়া গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কড়াকড়ির কারণে ৪০ শতাংশ গাড়ি সড়কে নেই। ফিটনেসবিহীন গাড়ি যাতে চলতে না পারে এবং লাইসেন্স ছাড়া কেউ যাতে গাড়ি না চালায় আমরা সে ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে। দুই দিন ধরে আমরা নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছি। আমরা চাই, সড়কে শৃঙ্খলা আসুক। কিন্তু গাড়ির ফিটনেসের জন্য বিআরটিএতে নিয়ে গেলে বিভিন্ন অজুহাতে তারা ফিটনেস করছে না। অনেক গাড়িকে ১৫-২০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হচ্ছে। মালিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাই হয়তো তারা গাড়ি নামাচ্ছে না।’

চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী মঞ্জু বলেন, ‘বিআরটিএ গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যেগুলো অবৈধ ও ত্রুটিপূর্ণ পাচ্ছে, সেসব গাড়ি ও চালকের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করছে ট্রাফিক বিভাগ।’ নগরীর সড়কে হঠাৎ গাড়ি উধাও প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের একটাই বক্তব্য, ফিটনেসবিহীন কোনো গাড়ি সড়কে উঠতে পারবে না এবং কোনো শ্রমিক লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাতে পারবে না। সড়কে কড়াকড়ির পাশাপাশি অনেক মালিক হয়রানির শিকার হচ্ছে। এসব কারণে হয়তো অনেকে গাড়ি নামাচ্ছে না।’

বাংলাদেশ পরিবহন মালিক ফেডারেশনের সহসভাপতি গোলাম রসুল বাবুল বলেন, ‘গাড়ির কোনো কাগজপত্র না থাকলে বা কোনো ত্রুটি থাকলে মামলা-জরিমানা করুক তাতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে গাড়ি জব্দ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে মালিকরা চিন্তিত হয়ে পড়েছে। গাড়ির সমস্যাগুলো তো একদিনের নয়। একটু সময় লাগবে। সে সময় তো দিতে হবে।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, ‘সিইপিজেডে শ্রমিকদের আনা-নেওয়ায় রিজার্ভ ভাড়ার কারণে এমনিতে নগরীর গণপরিবহন ৩০ শতাংশ কমে যায়। আমরা ব্যবস্থা নিতে বলেছি। কিন্তু প্রশাসন কিছুই করে না। এর ওপর আজকে গাড়ি নেই ৩০-৪০ শতাংশ। সব মিলে আজকে আমার মনে হয় ৬০-৭০ শতাংশ গাড়ি সড়কে নেই। মালিকরা কেন গাড়ি নামাচ্ছে না তার জন্য প্রশাসন তো কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির চট্টগ্রাম বিভাগের সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম নবী বলেন, ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে পণ্যবাহী অনেক গাড়ির চালকের লাইসেন্স নেই। আবার অনেকের আছে হালকা লাইসেন্স। কিন্তু হালকা লাইসেন্স দিয়ে ভারী গাড়ি চালাতে পারবে না। আমরা আজকে এসব গাড়ি দেখেছি। মামলা ও জরিমানা করা হচ্ছে। তবে লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা দেশে প্রায় ১২ লাখ। চট্টগ্রামেও অনেকে ভুয়া লাইসেন্সে গাড়ি চালাচ্ছে।’

এদিকে আজ বুধবার নগরীর শাহ আমানত সেতু এলাকায় জেলা মালিক সমিতির সচেতনতামূলক কর্মসূচি থাকলেও মালিক-শ্রমিকদের একটি পক্ষের অনীহার কারণে তা হচ্ছে না। ওই মালিক-শ্রমিকরা সচেতনতামূলক কর্মসূচির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় সড়কে শৃঙ্খলা আনয়নে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মালিক সংগঠনের একাধিক নেতা জানান।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2018/09/05/676690