৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:০৮

আরপিও সংশোধনী নিয়ে ইসিতে লুকোচুরি

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-১৯৭২ সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদনের পর মুখে কুলুপ এঁটেছে নির্বাচন কমিশন। গত সোমবার খসড়াটি ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ইভিএম যুক্ত করে আরপিও সংশোধনের বিষয়টি প্রকাশ করলেও সেখানে আর কি কি সংশোধনী রয়েছে তা গোপন রেখেছে ইসি। ইসি’র আইন সংস্কার কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্বে আছেন নির্বাচন কমিশনার বেগম কবিতা খানম। গতকাল দিনভর চেষ্টা করেও তার সঙ্গে সাংবাদিকরা আরপিও নিয়ে কথা বলতে পারেননি। নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদও এবিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। ইসি সূত্রে জানা গেছে, ‘নির্বাচনব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ক্রয়, সংরক্ষণ ও ব্যবহার’ শীর্ষক পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পের অধীনে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয় করতে চায় ইসি। এজন্য জাতীয় নির্বাচনের চার মাসেরও কম সময় সামনে রেখে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই কমিশনে এ প্রস্তাব পাঠানো হয়।

৩০শে আগস্ট কমিশন সভায় আরপিও সংশোধনের বিরোধিতা করে নোট অব ডিসেন্ট দেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। কমিশন সভাও বর্জন করেন তিনি। পরবর্তীতে ইভিএম ব্যবহারে তাড়াহুড়ো না করার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর অস্বস্তিতে পড়ে কমিশন। এই অস্বস্তির মধ্যেই গত সোমবার আরপিও’র খসড়া ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ইসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খসড়ার কপি অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে সংরক্ষণ করছে ইসি। ইসি’র আইন শাখা, নির্বাচন সহায়তা শাখা ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার কোনো কর্মকর্তার কাছে খসড়ার কোনো অনুলিপি পাঠানো হয়নি। পুরো বিষয়টি ইসি সচিবের দপ্তর থেকে তদারকি করা হচ্ছে।

৩৫তম কমিশন সভায় উপস্থিত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ইসির সুপারিশগুলো খুবই দুর্বল। এ ধরনের সুপারিশ আইনে রূপ পেলে যেমন নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে না। একই ভাবে, অনিয়ম ঠেকাতে নির্বাচনে কমিশনের ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে না। অতীতের মতো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ইসি’র সীমারেখা সংকুচিত হয়ে যাবে। নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালী কিংবা নির্বাচনে কমিশনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে, এমন কোনো বিধি-বিধান যুক্ত না করেই কমিশন সভায় অনুমোদিত সংশোধিত আরপিও’র প্রস্তাবনাটি সচিবালয়ে পাঠানো হয়। কর্মকর্তারা জানান, সংশোধিত আরপিও’র প্রস্তাবে কম-বেশি ১০টি সুপারিশ রাখা হয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার বিধান এবং আলোচিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) যুক্ত হয়েছে। এর আগে আরপিও সংশোধন সংক্রান্ত আইন সংস্কার কমিটি ৩৫টি সংশোধনের প্রস্তাব সুপারিশ করেছিল সেখানে নির্বাচনে ইসি’র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কিছুটা সুযোগ ছিল।


ইসি কর্মকর্তাদের মতে, ইভিএম আরপিও’র সংজ্ঞায় যুক্ত করাসহ প্রায় একডজন সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠিয়েছে ইসি। এসব সুপারিশ সংক্রান্ত ধারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে না। কারণ নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালী ও নির্বাচনে কমিশনের ক্ষমতা প্রয়োগের সক্ষমতার জন্য আরপিও’তে বিধি-বিধান সংযোজন-বিয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি তা চূড়ান্ত প্রস্তাবে যুক্ত হয়নি। শুধু আরপিও’র যে সংশোধনী আনার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে এর মধ্যে ইভিএম আরপিওতে যুক্ত করা হয়েছে যাতে সংসদ নির্বাচনে এটা ব্যবহারের ক্ষেত্র তৈরি হয়। বর্তমানে এটি স্থানীয় নির্বাচনের বিভিন্ন স্তরে ব্যবহার হচ্ছে। অনলাইনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার বিধান করা হয়েছে সংশোধিত আরপিও’র খসড়া প্রস্তাবনায়। আগে প্রার্থী নিজে কিংবা প্রতিনিধির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে জমা দেয়া লাগতো। নির্বাচনে দায়িত্ব পালনরত কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারের ক্ষমতা থাকলেও এবার এর সঙ্গে বদলির ক্ষমতা চাওয়া হয়েছে। আর ঋণ খেলাপিদের মনোনয়নপত্র জমার আগ পর্যন্ত ঋণ-পুনঃতফসিলের বিধান রাখার প্রস্তাব রয়েছে। আগে তফসিল ঘোষণার আগে ঋণ পুনঃতফসিলের বিধান ছিল।

স্থানীয় নির্বাচনে প্রত্যেক প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে টিআইএন সনদ যুক্ত করার বিধানে এবার জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জন্য এটা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিলে যাচাইয়ে একজনের মনোনয়নপত্র বৈধ হলে যাচাইয়ের সময় তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হতো। নতুন সংশোধিত প্রস্তাবে যাচাইয়ের পরিবর্তে প্রার্থী প্রত্যাহারের পর একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করা যাবে। নির্বাচনের কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হলে নির্বাচনের আপিল ট্রাইব্যুনালে মোকদ্দমা করতে ৫ হাজার টাকা জমা দিতে হতো, নতুন সংশোধিত প্রস্তাবে টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। আর প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র অফেরতযোগ্য করা হয়েছে; ফি ২৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, আরপিও সংশোধনে ইসি’র আইন সংস্কার কমিটির ৩৫ সুপারিশের মধ্যে অন্যতম ছিল, আরপিও’র ৯১ এ (১) ধারায় সংশোধনী। এ ধারাতে বলা ছিল নির্বাচনে বিচারিক কর্মকর্তাদের অবাধ ক্ষমতা প্রদান। সেখানে নির্বাচনী অপরাধের জন্য সামারি ট্রায়াল করে শাস্তি দেয়ার প্রস্তাব ছিল ইসি’র। এমনকি অপরাধের শাস্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশনকে সুপারিশ করতে পারবে এবং প্যানেল কোডে যেভাবে অপরাধের শাস্তির বিধান রয়েছে তার আলোকে সাজা দেবেন এসব কর্মকর্তা। সংশোধিত আরপিওতে এ বিধানটি বাদ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র কোনো ব্যক্তি প্রার্থী হলে মোট ভোটারের ১ শতাংশ জনের স্বাক্ষর নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হতো; এ ঘটনায় অনেক ব্যক্তি প্রার্থী হওয়াতে বঞ্চিত হতেন। রাজনৈতিক দলবহির্ভূত এসব প্রার্থীর শর্ত শিথিল করে ১ হাজার ভোটারের স্বাক্ষর জমা দিয়ে প্রার্থী হতে পারবেন; এ বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করেছিল আইন সংস্কার কমিটি, এটিও সংশোধিত আরপিওতে রাখা হয়নি বলে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

এছাড়া কমিটির অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে নির্বাচনে অবৈধ টাকার প্রভাব ও প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়সীমা নির্দিষ্ট রাখতে ব্যয় মনিটরিং কমিটি ও অডিটের নিমিত্তে আলাদা কমিটি গঠন, নির্বাচনে অভিযোগ দাখিল ও তা দ্রুত সময়ে নিষ্পত্তি হলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ফেরাতে এ বিধান সংযোজন, নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বদলি করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা, নির্বাচন কর্মকর্তাদের সাজা বাড়িয়ে সর্বনিম্ন তিন বছর করার বিধান যুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, নির্বাচনী অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করে অভিযোগকারীকে জানিয়ে দেয়া এসব বিধানও রাখা হয়নি এ প্রস্তাবে।
উল্লেখ্য, ভেটিংয়ে মন্ত্রণালয় ইসির প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ না করলে আসন্ন ৯ই সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া সংসদ অধিবেশনে আইনটি পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

http://mzamin.com/article.php?mzamin=133962