৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:০৪

বিভাগীয় পরীক্ষা বাদ ও বিধি লঙ্ঘন করে পদোন্নতির তালিকা

পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসির) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে সরকারি কলেজে শিক্ষকতার জন্য নিয়োগপ্রাপ্তরা লেকচারার বা প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। পর্যায়ক্রমে তারা সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক এবং সর্বশেষে অধ্যাপক পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে চাকরিজীবন শেষ করেন। এর আগে তারা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট রুলস (বিএসআর) ১৯৮১ এর ৫, ৬ ও ৭ বিধি অনুযায়ী- বিসিএসের মাধ্যমে সব ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তদের মতোই বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস ও শিক্ষানবিসকাল শেষে তাদের চাকরি স্থায়ী হয়। তাদের পরবর্তী সব পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস বাধ্যতামূলক।

বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি কলেজে নিয়োগপ্রাপ্তরা শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবেই পরিচিতি হন। শিক্ষা ক্যাডারের যারা এসব যোগ্যতা (সব পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস বাধ্যতামূলক) অর্জনে ব্যর্থ, তাদের চাকরির মেয়াদ ১৫ বছর পূর্ণ হলেই পরীক্ষা প্রমার্জন (বিশেষ ক্ষমা) সাপেক্ষে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হবেন। প্রমার্জনপ্রাপ্তরা প্রভাষক বা লেকচারার থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেলে পাঁচ বছর ওই পদে কর্মরত থাকার পরে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির যোগ্য হবেন। কিন্তু কোনোভাবেই অধ্যাপক হতে পারবেন না। যারা বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস করেছেন তারাই কেবল সহকারী অধ্যাপক পদে তিন বছর ফিডার সার্ভিস পূর্তিতে সহযোগী অধ্যাপক এবং দুই বছর ফিডার সার্ভিস পূর্তিতে অধ্যাপক হতে পারবেন। পদোন্নতি বিধির অন্যতম শর্ত হচ্ছে, বিভাগীয় পরীক্ষা পাস বাধ্যতামূলক। ২০০৬ সাল থেকে পদোন্নতির এ বিধি লঙ্ঘন করে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষা ক্যাডারে চরম অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। উল্লেখ্য, ফিডার সার্ভিস বলতে শিক্ষা ক্যাডারের মূল পদ সরকারি কলেজে কর্মরত থাকাকে বোঝায়।

শিক্ষকদের জীবনে ‘অধ্যাপক’ পদে পদোন্নতিপ্রাপ্তি সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও কলেজ শিক্ষকদের মতো লেকচারার বা প্রভাষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তির পর সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক এবং সর্বশেষে অধ্যাপক পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়ার জন্য যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে নিয়মিত পাঠদান, গবেষণা ও বিভাগীয় জার্নালে এবং আন্তর্জাতিক জার্নাল বা ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে বিষয়ভিত্তিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশনাসহ বিভিন্ন ধরনের অ্যাকাডেমিক কর্মকাণ্ডে নিজ যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। যিনি যত বেশি গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ দিতে পারেন, প্রতিটি পদোন্নতির ক্ষেত্রে এসব বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

কিন্তু সরকারি কলেজগুলোতে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভাগীয় ন্যূনতম পরীক্ষাটিও বাদ দিয়ে বিধি লঙ্ঘনের যে বিধি চালু করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারি কলেজশিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কলেজে পাঠদানের ন্যূনতম ধারাবাহিকতা না থাকা এবং বিষয়ভিত্তিক গবেষণা বা গবেষণার সাথে সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ ছাড়াই সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক পদে পদোন্নতির যে ধারা চালু করা হয়েছে, তাতে অধ্যাপক নামক বিশেষ ‘পদবি’Ñ বা ‘সম্মানজনক’ পদেরই অপমান করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারি কলেজশিক্ষকদের অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিধি লঙ্ঘন সম্পর্কে মন্তব্য করতে অনুরোধ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ গতকাল সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে বলেন, গবেষণা বা প্রকাশনা ছাড়া কোনো শিক্ষক অধ্যাপক হবেন এটি হতে পারে না। সমাজের বা প্রশাসনের অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে মেধা না থাকলেও চলে, কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষকের মেধা ছাড়া অন্য কোনো যোগ্যতাই বিবেচিত ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা ক্ষেত্রসহ সর্বত্রই যে ধ্বংসের চিত্র ফুটে উঠেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি বলেন, আগামীতেও যদি সরকার বা ক্ষমতার পালা বদল হয়, সে সময়ও এসব বিষয়ে খুব শক্তভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়াও দুঃসহ হয়ে দাঁড়াবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা ও গড়ে তোলা খুবই দুঃখজনক। এটি আগামীতে পুরো জাতীয় জীবনে দুর্যোগই বয়ে আনবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) সূত্রে ও এ প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্যানুসারে জানা যায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অধ্যাপকদের অবসরে যাওয়ার হিসাব করে ১৯টি বিষয়ের অধ্যাপক পদে পদোন্নতির খসড়া তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাতে এক হাজার ৯১ জনের নাম রয়েছে। সারা দেশের সরকারি কলেজে বর্তমানে ৯৮টি অধ্যাপক পদ শূন্য রয়েছে। আর আগামী ডিসেম্বরে ৮০ জন অবসরে যাবেন। এ হিসাব অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হবে। মন্ত্রণালয় ও মাউশির যৌথ উদ্যোগে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখেই এসব পদোন্নতির জন্য বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির বৈঠকে ওপরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে আগামীতে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে ওই সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত রূপ দেয়া হবে।

মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে ঈদুল আজহার আগে ‘বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি)’ সভা হয়েছে। সেখানেই তালিকার খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। তালিকা থেকে বিষয়ভিত্তিক ২০ শতাংশ সহযোগী অধ্যাপককে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
চাকরি বিধি ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ২০০৬ সাল থেকে পদোন্নতির ফলে পদোন্নতিবঞ্চিত শিক্ষকদের অভিযোগ, গত সাত বছরে প্রায় এক হাজার অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষায় ফেল করা। তবুও অধ্যাপক হয়েছেন। তারাই এখন মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দফতর, অধিদফতর, শিক্ষা বোর্ডসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে এবং ঐতিহ্যবাহী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও পদায়ন পেয়েছেন।
২০০৬ থেকে ২০১৭ সালের অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জ্যেষ্ঠতা তালিকা ও ফিট লিস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ও ২৩ অক্টোবর দুই দফায় ৫৮৭ জন পদোন্নতিপ্রাপ্ত অধ্যাপকের মধ্যে ১৫৪ জন এবং ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবরে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ৩৬৭ জন অধ্যাপকের মধ্যে দুই শতাধিক বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষায় ফেল করা। ২০১৪ সালে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ১৪৮ জন অধ্যাপক অযোগ্য ছিলেন।

মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান ডিপিসির বৈঠকে পদোন্নতির তালিকা করার বিষয়টি স্বীকার করে নয়া দিগন্তকে বলেন, বৈঠকে শুধু এসিআর (বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন) পর্যালোচনা করা হয়েছে। কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার তার কর্মস্থল সরকারি কবি নজরুল কলেজে স্বীয় কার্যালয়ে গতকাল দুপুরে নয়া দিগন্তকে বলেন, অন্যান্য ক্যাডারের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কেস টু কেস পর্যালোচনা করা হয়। কিন্তু আমাদের মন্ত্রণালয়ে এ ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে যারা প্রতিবারই বাদ ও বঞ্চিত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা থাকবেই।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/346362