৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:০৩

বেপরোয়া পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপগুলো

পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। খুন-জখম, ধর্ষণ, চাঁদাবাজির পাশাপাশি সম্প্রতি তারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে মানুষের বাড়িঘর ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ডাকাতি-লুণ্ঠনের মতো অপতৎপরতাও শুরু করেছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, পাহাড়ি জনপদকে অশান্ত করতে এভাবে একের পর ঘটনা ঘটিয়ে চলছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।

নানা অপরাধী কর্মকাণ্ডের সাথে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা এবার নেমেছে লুটপাটে। প্রকাশ্যে শত শত লোকের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে এরা লুটপাট করছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে শুরু করে দুুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রকাশ্যে বান্দরবানের লামা সদর ইউনিয়নের ছোট বমু, পোয়াং পাড়া ও মেরাখোলা এলাকায় দোকানপাটে লুটপাট চালায় তারা। স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রায় ৪০ জনের একটি পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপ আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত হয়ে প্রকাশ্যে ওই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর মালামাল লুট করেছে। লুটপাট করে যাওয়ার সময় নকশা ঝিরি এলাকায় সেনাবাহিনীর সাথে সন্ত্রাসীদের গুলিবিনিময় হয়েছে বলে জানা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পরে ঘটনাস্থলে গিয়েছে। সূত্র জানায়, পাহাড়ে প্রকাশ্যে লুটপাটের ঘটনা অনেক দিন বন্ধ ছিল। এমন ঘটনায় আবারো চরম আতঙ্ক শুরু হয়েছে পার্বত্য এলাকায়।

স্থানীয় সূত্র জানায়, পাহাড়ি অঞ্চলের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই নানা সঙ্ঘাত চলে আসছে। এ সঙ্ঘাতে চলতি বছরে প্রায় ৪০ জন প্রাণ হারিয়েছে। সর্বশেষ বড় ঘটনা ঘটে গত ১৯ আগস্ট খাগড়াছড়ি জেলা সদরের স্বনির্ভর বাজার এলাকায়। সেখানে ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পিসিপির সভাপতিসহ নিহত হয় সাতজন। নিহতরা হলেন, পিসিপির জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তপন চাকমা, সহসাধারণ সম্পাদক এলটন চাকমা, পলাশ চাকমা, রূপক চাকমা, বরুন চাকমা, জীতায়ন চাকমা। এর আগে ১৩ জুলাই খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান চঞ্চুমনি চাকমা দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত হন। একই দিনে জেলার আলুটিলায় প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত ইউপিডিএফ কর্মী জ্ঞানেন্দু চাকমা লাশ নিতে গেলে তার ছোট ভাই কালায়ন চাকমাকে (২২) অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। আগের দিন জ্ঞানেন্দু চাকমা নিহত হন। এ ঘটনায় জেএসএস সংস্কারকে দায়ী করে ইউপিডিএফ। গত ৩ মে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনার পর অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন বড় ধরনের সহিংস ঘটনার। অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা ২০১০ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি থেকে বেরিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা) নামে গঠিত নতুন দলে যোগ দেন। সংস্কারপন্থী এ নেতা ছিলেন ওই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি।

ওই আশঙ্কা ঠিক এক দিন পরই প্রমাণিত হয়। ৪ মে শক্তিমান চাকমার দাহক্রিয়ায় অংশ নিতে গিয়ে পথে সশস্ত্র হামলায় নিহত হন ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা, একই দলের নেতা সুজন চাকমা, সেতুলাল চাকমা ও টনক চাকমা। তাদের বাঙালি গাড়িচালক সজীবও নিহত হন।
ওই ঘটনার চার মাস আগে নিহত হয়েছেন ইউপিডিএফের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি মিঠুন চাকমা। তার কয়েক দিন আগে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটলে মিঠুন ওই দলে যোগ দিয়েছিলেন। গত ৩ জানুয়ারি কোর্টে হাজিরা শেষে বাড়িতে গেলে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

সূত্র জানায়, পাহাড়ে চারটি সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠন প্রতিনিয়ত খুনখারাবি করে যাচ্ছে। প্রথমে এ অঞ্চলে সশস্ত্র সংগঠন ছিল শুধু জেএসএস। পরে জেএসএস ভেঙে ইউপিডিএফ গঠিত হয়। তখন থেকে পাহাড়ি অঞ্চলে জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যে সঙ্ঘাত সংঘর্ষ হতো। তারপর জেএসএস সংস্কার নামে আর একটি সশস্ত্র গ্রুপের আত্মপ্রকাশ ঘটলে তখন সংঘর্ষ হতো তিন গ্রুপে। ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়ির খাগড়াপুরে একটি কমিউনিটি সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে আত্মপ্রকাশ করে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে আরেকটি গ্রুপ। ইউপিডিএফ থেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বহিষ্কৃত এবং জনসংহতি সমিতির সংস্কারপন্থী অংশের কিছু নেতাকর্মী এ দলটি গঠনের পেছনে ছিলেন বলে জানা গেছে। দল ভাঙার দেড় মাসের মাথায় খুন হন মিঠুন চাকমা। এর আগে খুন হন দলের নেতা অনিল চাকমা ও অভিলাষ চাকমা। এ ছাড়া অনিল চাকমার অনুসারী ভেবে লক্ষ্মীছড়িতে রয়েল মারমাকে পেছন থেকে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই কায়দায় রঞ্জন মুনি চাকমার (আদি) নেতৃত্বে বাঘাইছড়ির জারুলছড়িতে অনিল চাকমার শ্বশুরবাড়িতে সাহসী ও দক্ষ কর্মী স্টেন চাকমাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।

ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এবং জনসংহতি সমিতির (জেএসএস-এমএন লারমার) পাঁচ নেতাকর্মী খুনের এক মাসের মধ্যে গত ২৮ মে বাঘাইছড়ি উপজেলায় নিহত হন সুনীল চাকমা সনজিৎ (৩০), অটল চাকমা (৩০) ও স্মৃতি চাকমা। নিহতরা ছিলেন প্রসিত বিকাশ খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের সদস্য। ইউপিডিএফ দাবি করেছে, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস (এমএন লারমা) এ খুনের সাথে জড়িত।
স্থানীয় সূত্র জানায়, পাহাড়ে চারটি সশস্ত্র গ্রুপ নানা অপকর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট। গ্রুপগুলো আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে আগের চেয়েও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, যে কারণে তারা প্রকাশ্যে লুণ্ঠনের মতো ঘটনা শুরু করেছে। এ পরিস্থিতি পাহাড়ের সাধারণ মানুষকে আরো আতঙ্কিত করে তুলেছে

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/346363