৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১১:২৩

গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরেনি

সড়কে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছেই

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সরকারের উচ্চমহল থেকে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সরব হয়েছে পরিবহন মালিক সমিতিও। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সড়কে মৃতু্যৃর মিছিলই বলে দিচ্ছে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরেনি। বরং দিন যতো যাচ্ছে পরিস্থিতির ততোই অবনতি ঘটছে। চট্টগ্রামে বাস থেকে ফেলে যাত্রী হত্যা, কুষ্টিয়ায় বাসের ধাক্কায় মায়ের কোলে থাকা শিশুর মৃত্যু, মিরপুরে জব্দ করা বাসচাপায় পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর মতো সাম্প্রতিক নৈরাজ্য সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
রাজধানীসহ সারাদেশের সড়কে-মহাসড়কে বাস-মিনিবাসের বেপরোয়া চলাচল, পাল্লাপাল্লি করে ছুটে চলা, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করানো, ট্রাফিক নিয়ম লঙ্ঘন, ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করে হাত উচিঁয়ে গাড়ি থামিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার কোনোটাই বন্ধ হয়নি। এর সাথে ভাড়া নিয়ে জালিয়াতি, সিটিং ও বিরতিহীনের নামে প্রতারণাতো আছেই।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে রাজধানীর সড়কে গাড়ির সংখ্যা কম দেখা গেলেও এখনও চলছে ফিটনেসবিহীন বাস ও মিনিবাস। ভুক্তভোগি যাত্রীদের অভিযোগ, ঈদের আগে থেকেই কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় চলছেই। ট্রাফিক পুলিশের একাধিক সদস্যের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরাতে সারাদেশে যেভাবে সাড়া পড়েছিল, এখন তার সবই ম্লান হওয়ার পথে। কাগজপত্রবিহীন গাড়ি না ধরার জন্য আবার আগের মতোই পুলিশের উপর প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনদের চাপ অব্যাহত রয়েছে। তারপরেও কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে যাত্রীদের সচেতনতা মোটেও বাড়েনি। যাত্রীরা সচেতন না হলে পুলিশ একা কি করবে? সব মিলে গণপরিবহনে আগের মতোই বিশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করছে। যা সাধারণ মানুষকে হতবাক ও হতাশ করেছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজ্জাম্মেল হক চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো কঠিন কাজ। কারণ পরিবহন ব্যবসার নেপথ্যে রয়েছে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি। প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে এই সেক্টর থেকে। এই চাঁদা তোলা বন্ধ করা না গেলে এই সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, পরিবহন সেক্টরে কবে শৃঙ্খলা ফিরবে তা বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা মালিক-শ্রমিক সব পক্ষের সাথেই মিটিং করছি। আগামীতেও মিটিং হবে। তিনি বলেন, চালকসহ পরিবহন শ্রমিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মালিকপক্ষকে আমরা তাগিদ দিয়েছি। কিন্তু সেটা ঠিকমতো পালন করা হচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে।

মালিকপক্ষের দাবি, নগরীতে এখন যেসব বাস চলাচল করছে সেগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে। যেগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই, সেগুলো রাস্তায় নামছে না। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো, এখনও ফিটনেসবিহীন বাস বা মিনিবাস চলাচল করছে। আলাপকালে কয়েকজন চালক জানান, পুলিশ আগের মতো আর কাগজপত্র চেক করে না। এই সুযোগে অনেক বাসই রাস্তায় নেমেছে। সরেজমিনে গুলিস্তান এলাকায় কয়েকটি বাস পরিদর্শন করে দেকা গেছে, বেশিরভাগ বাসের সীট নড়বড়ে, দরজা-জানালা নাই, বডি থেকে টিন খুলে পড়েছে, সামনে-পেছনের লাইট জ্বলে না, হুইস পাইপ দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, চলতে গিয়ে বিকট শব্দ হয় আরও কতো কি? চলাচলের ক্ষেত্রে এসব বাসের বেপরোয়া গতি যাত্রীদেরকে আতঙ্কিত করে তুলছে। নারায়ণগঞ্জের শিমরাইল থেকে গুলিস্তানে আসে আকরাম নামে এক যাত্রী গতকাল সোমবার দুপুরে বলেন, কমল পরিবহনের একটি বাসে তিনি এসেছেন। বাসটির চালক অল্প বয়সি। পথিমধ্যে সে বেশ কয়েকটি বাসকে পেছনে ফেলার জন্য খুবই দ্রুতবেগে এসেছে। এক পর্যায়ে ঝুঁকির কথা ভেবে যাত্রীরা হই চই শুরু করলে চালক কিছুটা শান্ত হয়ে গাড়ি চালায়। তারপরেও পথিমধ্যে সে যাত্রী তোলার জন্য এক ঘণ্টারও বেশি সময় নষ্ট করেছে। শোয়েব নামে একজন যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, রায়েরবাগ থেকে যাত্রাবাড়ীর ভাড়া ১০ টাকা হলেও ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে আসার কারণে অনেকের কাছে থেকে ১৫ টাকা করে ভাড়া আদায় করা হয়েছে। এ নিয়ে বাসের মধ্যে বাকবিতন্ডাও হয়েছে। শুধু গুলিস্তানে নয়, রাজধানীর সবগুলো রুটেই একই চিত্র। নিয়ম, শৃঙখলা, আইন মানে না বেশিরভাগ বাস চালকই।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের মুখে গতকাল বিকালেও একাধিক বাসকে পাল্লাপাল্লি করে যাত্রী তুলতে দেখা গেছে। একজন যাত্রী জানান, শ্রাবণ পরিবহনের বাসের সাথে কোমল পরিবহনের বাসের এমন পাল্লাপাল্লির সময় যাত্রীরা ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলে চালক আর না দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করে। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তা বন্ধ করে তুরাগ পরিবহনের বাসে যাত্রী তোলা হচ্ছে। একই চিত্র দেখা গেছে গুলিস্তানে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে। গুলিস্তান থেকে ফ্লাইওভার দিয়ে রায়েরবাগ, সাইনবোর্ডের বাসগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে যাত্রী তুলছে। যাত্রীরা বাসে ওঠার জন্য চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়েই দৌড় দিচ্ছে। অথচ অদূরেই দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশ। এতোকিছুর পরেও বন্ধ হচ্ছে না বিশৃঙ্খলা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরেও পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরার কোনো লক্ষণ দেখছি না। আমরা আশা করেছিলাম, শিক্ষার্থীরা আমাদেরকে যে পথ দেখিয়ে গেছে তার একটা ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। কিন্তু গত কয়েক দিনে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। আগের মতোই গাড়িগুলো লেন মেনে চলছে না। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে, পাল্লাপাল্লি করছে। তিনি বলেন, আন্দোলনের পর ট্রাফিক পুলিশ শুধু বড় অঙ্কের মামলা ও বিশাল অঙ্কের জরিমানা আদায় করেছে। কিন্তু তারা শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি।

জানা গেছে, ঢাকায় বাস কোম্পানি আছে ২৪৬টি। আর বাস চলে প্রায় ৮ হাজার। বেশিরভাগ বাসেরই ফিটনেসসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আপডেট নেই। তার প্রমান মিলেছে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময়।
জানা গেছে, প্রভাবশালী রাজনীতিকদের বাস কোম্পানি থাকায় এতোদিন ফিটনেসবিহীন, রংচটা, লক্কর-ঝক্কর মার্কা বাসের বিরুদ্ধে খুব একটা ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রভাবশালী মালিকের বাস চালকেরা বরাবরই বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে গাড়ি চালিয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে কোনো যাত্রী উচ্চবাচ্য করলে তাদের শায়েস্তা করার জন্যও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নিজেদের লোক রাখেন পরিবহন মালিকেরা। এ কারণে সিটিং, বিরতিহীন, সময় নিয়ন্ত্রণ, গেইটলকসহ নানা কৌশলে সরকার-নির্ধারিত হারের দু-তিন গুণ ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও কোনো সুফল পান না যাত্রীরা। কিছুদিনের জন্য সে অবস্থার পরিবর্তন হলেও আবার আগের পরিবেশই ফিরে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকায় তিনটি রুটে চলাচল করে সরকারের এক মন্ত্রীর পরিবারের মালিকানাধীন কোম্পানীর বাস। সরকারদলীয় দুজন বর্তমান ও একজন সাবেক এমপির নিজ নামেই পরিবহন কোম্পানি আছে। এর বাইরে এমপি পরিবারের সদস্য, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সরকার-সমর্থক কাউন্সিলরসহ ২০ থেকে ২৫ জন নিজ নামে বা পরিবারের সদস্যদের নামে কোম্পানি করে বাস পরিচালনা করছেন। আবার পুলিশের সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ভাই, ছাত্রলীগের সাবেক একজন সাধারণ সম্পাদকের কোম্পানির অধীনেও বাস-মিনিবাস চলছে ঢাকায়। আছে একটি বিশেষ জেলার কিছু ব্যক্তির বাস কোম্পানীও। সাধারণ মালিকরা জানান, প্রভাবশালী এসব মালিকের বাসগুলোর চালক শ্রমিকরাও নিজেদেরকে প্রভাবশালীই মনে করে। বেপরোয়া চলাচলে তারা দ্বিধাবোধ করে না। ট্রাফিক পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্যের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর এসব প্রভাবশালী মহল কিছুদিনের জন্য নিস্ক্রিয় থাকলে এখন তারা আবার সক্রিয় হয়েছে। এ কারণে পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই ছাড় দিতে বাধ্য হচ্ছে।

এদিকে, দেশের সড়ক-মহাসড়কে প্রতিদিনই ঝরছে তাজা প্রাণ। বাস চালকদের বেপরোয়া গতি ও খামখেয়ালির কারণে ঈদের আগে থেকে সারাদেশেই দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে ঈদ যাত্রার ১৩ দিনে সারাদেশে ২৩৭টি দুর্ঘটনায় ২৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ৯৬০জন।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, বেপরোয়া গতি, পণ্যবাহী পরিবহনে যাত্রীবহন, অদক্ষ চালক, বিরতিহীন গাড়ি চালানো, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মহাসড়কে নছিমন-করিমনজাতীয় ছোট যানের চলাচলের কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।
ঈদের পর গত দুই সপ্তাহ থেকেই সড়কে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছেই। গত রোববার দিবাগত রাতে ঢাকার সাভারের বলিয়ারপুর এলাকায় সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যাওয়া একটি পিকআপভ্যান থেকে তিনটি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। একই দিন বিকালে মিরপুরে এক বাস চাপায় পুলিশের এক সাব-ইন্সপেক্টরের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। একটি পত্রিকার হিসাবে গত দেড় বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৫ হাজার ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর অধিকাংশ হয়েছে চালকদের খামখেয়ালি, সিগনাল না মানা, ওভারটেকিং ও অতিমাত্রার গতির কারণে।

গত ২৯ জুলাই বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস আরও দুটি বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ফুটপাতে অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের উপর তুলে দেয়। এতে ঘটনাস্থলে দুজন নিহত ও আরও ১০/১২জন আহত হয়। ওই ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ধীরে ধীরে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে রুপ নেয়। জাবালে নূর পরিবহন কোম্পানীর মালিক সরকারের এক মন্ত্রীর শ্যালক। বাস মালিকরা জানান, জাবালে নূরের মতো প্রভাবশালী মালিকের কোম্পানীর বাস যারা চালায় তাদের বেশিরভাগই বেপরোয়া। এদেরকে কোনোভাবেই নিবৃত করা সম্ভব নয়। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পরিবহন ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তারা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীনদের সাথে যুক্ত। এ ব্যবসায় অবৈধ টাকার ছড়াছড়ি বলে এখানে ক্ষমতা প্রদর্শন বেশি হয়। আর ওই ক্ষমতাকে পূঁজি করেই মালিক-শ্রমিকরা ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করে। তাদের সেই ক্ষমতার কাছে সাধারণ যাত্রী ও মানুষ অসহায়। #

https://www.dailyinqilab.com/article/151171