৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১১:১৭

মালয়েশিয়ায় ধরপাকড় চলছেই, আত্মগোপনে বহু বাংলাদেশি

মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে গতকাল রোববার রাত পর্যন্ত আটক করা হয়েছে দেড় সহস্রাধিক বিদেশি নাগরিককে। যাদের মধ্যে একটি
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক। আটককৃতদের ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশিসহ অবৈধভাবে কর্মরত এসব বিদেশি নাগরিকদের বৈধ হওয়ার জন্য কয়েকদফা সুযোগ দেয় দেশটির সরকার। এরমধ্যে যারা এই সুযোগ গ্রহণ করেনি তাদের ধরতেই অভিযান চলছে। এদিকে এই ধরপাকড়ের ভয়ে প্রায় কয়েক লাখ বাংলাদেশি কর্মক্ষত্রে যাচ্ছেন না। গ্রেপ্তার আতঙ্কে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
অভিযানের মধ্যে গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে যেতে গিয়ে বেশ কয়েকজন শ্রমিক আহতও হয়েছেন। এদিকে মালয়েশিয়ার নির্মাণখাত ও বিভিন্ন শিল্পকারখানায় কর্মরত বাংলাদেশিসহ বিদেশি শ্রমিকদের উপস্থিতি কমেছে। বিপাকে পড়েছেন কারখানার মালিকরাও। সূত্র জানায়, আটক বিদেশি নাগরিকদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। এসব ডিটেনশন ক্যাম্পের পরিবেশ অনেকটাই বসবাসের অযোগ্য।

সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ায় যারা পাচারকারীদের মাধ্যমে ট্রলারে বা পার্শ্ববর্তী দেশের বিভিন্ন রুট দিয়ে অবৈধ পথে এসেছেন তাদের বৈধতার আর কোনো সুযোগ নেই। মালয়েশিয়া সরকারও তাদের আর কোনো সুযোগ দিতে চায় না। মালয়েশিয়ায় কর্মরত এসব অবৈধ কর্মীদের বৈধ হওয়ার জন্য গত ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে যারা আবেদন করেছেন তারা ধরপাকড় থেকে রেহায় পাচ্ছেন। অন্যথায় যারা এই সুযোগ নেননি তারা পড়েছেন বিপাকে। এরপর শুক্রবার মধ্যরাত থেকে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে পুলিশ। রাজধানীর কুয়ালালামপুর, পেরাক, জোহর বারু, কোতা বারু, কেলান্তান, কেদাহ, আলোর সেতার, মালাকাসহ দেশটির প্রত্যন্ত প্রদেশগুলোতেও ব্যাপক অভিযান অব্যাহত আছে।

সূত্রমতে, গত তিনদিনে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের চিহ্নিত করতে ১২ হাজারের বেশি বিদেশি নাগরিকের পারমিট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। এরমধ্যে ১ হাজার ৫৪৭ জনই অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যাদেরকে ইমিগ্রেশন বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে।

যারা বৈধপথে অর্থাৎ পোর্ট অব এন্ট্রি দিয়ে মালয়েশিয়ায় এসেছেন তাদেরকে রিহায়ারিং বা পুনঃনিয়োগ প্রক্রিয়ায় বৈধ হওয়ার সুযোগ দেয়া হয় আগামী ৩১শে আগষ্ট পর্যন্ত। কিন্তু যারা পোর্ট অব এন্ট্রি দিয়ে আসেননি বা অন্য অবৈধ পথে গেছে তাদের আর বৈধতার সুযোগ নেই। এছাড়া যারা দেশটিতে ১০ বছরের বেশি সময় অবস্থান করছেন বা যাদের বয়স ৪৫ বছর পেরিয়ে গেছে তাদেরকে ৩১শে আগস্টের মধ্যে দেশ ছাড়তে আল্টিমেটাম দিয়েছিলো দেশটির সরকার। কিন্তু এই সুযোগ যারা গ্রহণ করেননি তারাও পাকড়াও হচ্ছেন। তাদেরও দেশটিতে অবস্থানের আর কোনো সুযোগ দেবে না বলে জানিয়েছিল।

সূত্র জানায়, দালাল চক্র ও একশ্রেণির মালিকদের অবহেলার কারণে প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশি বৈধ হওয়ার এই সুযোগ নিতে পারেননি। বৈধ প্রক্রিয়াকরণে জটিলতার কারণে অনেকেই দালালদের দ্বারস্থ হন। দালালরা তাদেরকে বৈধকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। ফলে প্রতারিত কর্মীরা দালালদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে সময় পেরিয়ে যায়। তারা আর বৈধ হতে পারেন না। এমনই একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসির। তিনি দেশটিতে একটি গ্রিলের কারখানায় কাজ করেন। ৪ বছর আগে তিনি দেশটিতে গিয়েছিলেন। তার ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ ছিলো দুই বছরের। এরপর তিনি তার পারমিটের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য এক দালালের শরণাপন্ন হন। তাকে ৯ হাজার রিঙ্গিত দেন। কিন্তু ওই দালাল অর্থ পেয়েই কেটে পড়ে। এরপর থেকে নাসির দুই বছর ধরে অবৈধ হিসেবেই কাজ করে যাচ্ছেন। নাসির বলেন, গত দুইবছর ধরে তিনি বিভিন্ন সময় পুলিশকে টাকা দিয়ে সেখানে অবস্থান করছেন। বর্তমানে আবারো ধরপাকড় শুরু হওয়ায় তিনি আত্মগোপনে আছেন। কাজেও যেতে পারছেন না। নাসিরের মতো লাখ লাখ বাংলাদেশি দেশটিতে গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে কেউ কেউ অবস্থা বুঝে ঝুঁকি নিয়েই কাজে যাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় অনেক মালিক ও দালাল অবৈধ কর্মীদের বৈধ হতে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলেন। তারা এসব কর্মীকে বোঝান মালয়েশিয়ান সরকার আবারো এই সুযোগ দেবে তাদের। কিছুদিন পর ধরপাকড়ও বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণেও অনেকে বিভ্রান্তিতে পড়ে বৈধতার সুযোগ নিতে পারেননি বা দেশে ফিরে আসেননি।

দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মো. ইলিয়াস বলেন, মাঝে-মধ্যেই দেশটির সরকার অবৈধদের ধরতে এই ধরনের উদ্যোগ নেয়। তার আগে দেশত্যাগ বা বৈধ হওয়ার জন্য একটি সময়সীমা বেঁধে দেন। কিন্তু কেউ কেউ সেই সুযোগ গ্রহণ করলেও বেশির ভাগই এর বাইরে থাকে। ফলে এই সময়টাতে আতঙ্কে থাকে অবৈধভাবে কর্মরত বাংলাদেশিসহ বিদেশি নাগরিকরা। কি কারণে বাংলাদেশিরা এই সুযোগ নিতে চান না এমন প্রশ্নের জবাবে এই ব্যবসায়ী বলেন, অভিযান চলার কিছুদিন পরই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অনেকের ধারণা এমন হয়েছে, কিছুদিন পরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এই ভরসায় তারা সরকারের এই সুযোগ না নিয়ে অভিযানের কয়েকদিন আত্মগোপনে থাকে। এছাড়া তিনি বৈধকরণ প্রক্রিয়ার জটিলতার কথাও তুলে ধরেন। বলেন, বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে অধিক কার্যকর হতো। এছাড়া অভিবাসন ব্যয় কমানোর কথাও বলেন, ব্যবসায়ী মো. ইলিয়াস।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=133788