৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, সোমবার, ২:১২

কোটেশন বাণিজ্যের ফাঁদে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

চলছে লুটপাট

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) প্রয়োজনীয় কোনো কাঁচামাল, রাসায়নিক অথবা দ্রব্যাদি কিনতে টেন্ডার ছাড়াই কোটেশনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত করে ব্যয় করতে পারে কর্তৃপক্ষ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইপিএইচ কর্তৃপক্ষ দুই লাখ টাকার কার্যাদেশ দেয়। তবে কার্যত কোনো কাঁচামাল ও রাসায়নিক কেনা হয় না। কারণ একটি চক্র দুই লাখ টাকার মধ্যে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা রেখে দেয়; বাকি ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয় ঠিকাদারকে। কোটেশন প্রক্রিয়ায় কেনাকাটার নামে ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে এই লুটপাট।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে কোটেশনের কাজ করেন স্থানীয় এমন এক ঠিকাদার সমকালকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চাহিদা অনুযায়ী মালপত্র সরবরাহ করবে। বাস্তবে তা ঘটে না। কোটেশনের মাধ্যমে দুই লাখ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হলে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা কর্তৃপক্ষই রেখে দেয়। ওই টাকায় কোনো কাঁচামাল কেনা হয় না। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মকর্তা ওই টাকা ভাগ করে নেন।

এই কোটেশন বাণিজ্যের কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে এখন স্যালাইন উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পথে। সংশ্নিষ্টরা জানাচ্ছেন, নিয়ম অনুযায়ী স্যালাইন, ব্লাড ব্যাগ, ব্লাড ট্রান্সমিশন সেট, রি-এজেন্ট, খাবার স্যালাইনসহ রোগীদের প্রয়োজনীয় ১২টি আইটেম জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে উৎপাদন করে সারাদেশের সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করার কথা। স্যালাইন তৈরির বিভিন্ন কাঁচামাল ও কেমিক্যাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু দীর্ঘ ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে এই আমদানি না করায় জুলাই মাস পর্যন্ত স্যালাইন উৎপাদন বন্ধ ছিল। তবে আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সীমিত পরিসরে উৎপাদন শুরু হয়েছে।

এর আগে জুন মাসে স্যালাইন সংকটের কথা জানিয়ে কয়েকটি সরকারি হাসপাতালের পরিচালক জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালককে চিঠি দেন। কিন্তু এ চিঠির জবাব পাননি তারা। আইপিএইচ সরবরাহ বন্ধ রাখায় সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদেরই স্যালাইন, ব্লাড ব্যাগ, ব্লাড ট্রান্সমিশন সেটসহ অন্যান্য দ্রব্য কিনতে হচ্ছে। কোনো কোনো হাসপাতালের পরিচালকরা অতিরিক্ত দামে স্যালাইন কিনে রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করছেন। এতে প্রতি ব্যাগ স্যালাইন বাবদ দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে।

এই সংকটের কারণ খুঁজতে গিয়ে আইপিএইচ-এর অন্তত পাঁচ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাস থেকে কর্তৃপক্ষ এমএসআর সামগ্রী কেনার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়ায় না গিয়ে কোটেশন পদ্ধতিতে কাজ করানোর পরিকল্পনা শুরু করে। এ সময় বিভিন্ন মেশিনারিজ মেরামত ও মালপত্র ক্রয় দেখিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকার কোটেশন করা হয়। কর্তৃপক্ষ এর মধ্যে প্রায় তিন কোটি টাকার মালপত্র নগদে কেনে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী পরিচালক এক বছরে কোটেশনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকার মালপত্র কিনতে পারবেন। কিন্তু পরিচালক এই নিয়ম ভেঙে কোটেশনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার কাঁচামাল ও এমএসআর সামগ্রী কেনাকাটা করেছেন।

দুর্নীতি প্রতি পদে :অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু চলতি বছরের ২৪ মে স্যালাইন, ব্লাড ব্যাগ, ব্লাড ট্রান্সমিশন সেট উৎপাদনের কাঁচামাল কেনার জন্য নৌবাহিনী পরিচালিত ডকইয়ার্ডকে মাত্র দুই কোটি ৫৩ লাখ ছয় হাজার পাঁচশ' টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। অবশিষ্ট অর্থ কোটেশন বাণিজ্যের জন্য রেখে দেওয়া হয়। অভিযোগ, দুই লাখ টাকা করে নগদ কোটেশন বাণিজ্যের জন্য জুন মাসজুড়ে প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিভাগ ও স্টোর শাখার কমকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে কাগজপত্র তৈরি করা হয়। বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে দুই লাখ টাকা করে কার্যাদেশ দিয়ে পরিচালক কয়েক কোটি টাকার কোটেশন বিল তোলেন। তবে বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় তিনি 'অব্যয়িত অর্থ' সরকারি কোষাগারে জমা দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, এর আগে প্রতিষ্ঠানটিতে যারা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন, তারাও কোটেশন বিলের নামে একই কাজ করেছেন। বর্তমান পরিচালক ডা. আবুল কালাম মো. আজাদ আগেও এই প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন। সেই সময়েও পরিচালকদের সঙ্গে যোগসাজশে তিনি কোটেশন বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। তবে পরিচালক হওয়ার পর তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। প্রতিষ্ঠানটির আরও তিন কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কোটেশন বাণিজ্যের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অথবা অধিদপ্তর থেকে কোটেশন বিলের ফাইল তলব করলে এ সংক্রান্ত প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

এদিকে সেনাবাহিনী পরিচালিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) দীর্ঘদিন ধরে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে (আইপিএইচ) চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মালপত্র সরবরাহ করে আসছে। কিন্তু বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় বিএমটিএফ কর্তৃপক্ষ আইপিএইচকে আর কোনো মাল সরবরাহ করবে না বলে জানিয়েছে। এতে আইপিএইচে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, যে কয়েকজন কর্মচারী প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন, তাদের মধ্যে আছেন হিসাবরক্ষক মাহবুব ও মো. নিজামউদ্দিন। হিসাবরক্ষক মাহবুব দুই যুগ ধরে একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। আর নিজামউদ্দিন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও তাকে ক্রয় ও সংগ্রহ কর্মকর্তা এবং স্টোর অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ফ্রিজ ও বিভিন্ন কেমিক্যাল চুরির দায়ে বিভাগীয় মামলাও রয়েছে। পরিচালক এই দুই কর্মচারীকে দিয়ে ২০ হাজার টাকা করে প্রায় তিন কোটি টাকার মালপত্র ক্রয় করিয়েছেন। অথচ পরিচালকের নগদ পাঁচ লাখ টাকার বেশি কেনাকাটার সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. আবুল কালাম মো. আজাদ সমকালকে বলেন, তিনি মাত্র সাড়ে তিন মাস আগে প্রতিষ্ঠানটিতে যোগ দিয়েছেন। আগের পরিচালকরা যথাসময়ে কাঁচামাল না কেনায় সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি যোগদানের পর কাঁচামাল ক্রয়ের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে দ্রুত কাঁচামাল কিনতে গিয়ে টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়াই কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে এবং আগস্ট মাস থেকে সীমিত পরিসরে উৎপাদন শুরু হয়েছে। কোটেশন বাণিজ্য ও কর্মচারীদের দুর্নীতি বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

স্যালাইন নেই, ভোগান্তি রোগীদের :এদিকে উৎপাদন বন্ধ থাকায় বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে রোগীসেবা ব্যাহত হচ্ছে। ভোগান্তিতে পড়ছেন বিশেষত দরিদ্র রোগীরা। গত জুন মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে এক হাজার ব্যাগ ১০০০ এমএল ৫ শতাংশ গ্লুকোজ, দেড় হাজার ব্যাগ ৫০০ এমএল গ্লুকোজ স্যালাইন, এক হাজার ব্যাগ ১০০০ এমএল নরমাল স্যালাইন, দেড় হাজার ব্যাগ ৫০০ এমএল কলেরা স্যালাইন, পাঁচশ ব্যাগ ১০০০ এমএল হার্টম্যান সলিউশন চেয়ে আইপিএইচে চিঠি দেওয়া হয়। তবে তা সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।

এ ছাড়া এক হাজার ব্যাগ ১০০০ এমএল অ্যাকুয়া স্যালাইনের বিপরীতে মাত্র ১০০ ব্যাগ, দেড় হাজার ব্যাগ ৫০০ এমএল অ্যাকুয়ার বিপরীতে ২০০ ব্যাগ, দেড় হাজার ব্যাগ ৫০০ এমএল নরমাল স্যালাইনের বিপরীতে ২০০ ব্যাগ, পাঁচশ' ব্যাগ ৫০০ এমএল বেবি স্যালাইনের বিপরীতে ১০০ ব্যাগ সরবরাহ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ২০০ ব্যাগ ৩ শতাংশ সোডিয়াম ক্লোরাইড স্যালাইনের বিপরীতে মাত্র ১০০ ব্যাগ সরবরাহ করা হয়েছে। একই মাসে মিটফোর্ড, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, রংপুর এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে স্যালাইনের চাহিদা পাঠানো হয়। এর আগে মার্চ মাসে সিলেট এমএজি ওসমানী, কুমিল্লা এবং দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকেও চাহিদা পাঠানো হয়। কিন্তু জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট কোনো হাসপাতালেই স্যালাইন সরবরাহ করতে পারেনি।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ূয়া সমকালকে বলেন, প্রতিদিন ৫০০-৫৫০ ব্যাগ স্যালাইন তার হাসপাতালে প্রয়োজন হয়। কিন্তু আইপিএইচ কয়েক মাস ধরে সপ্তাহে এক হাজার ২০০ ব্যাগ স্যালাইন সরবরাহ করে আসছে। অর্থাৎ তারা প্রতিদিন সরবরাহ করছে গড়ে ১৭১ ব্যাগ স্যালাইন। এ কারণে কয়েক মাস রোগীদেরই স্যালাইন কিনতে হয়েছে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে জানানোর পর হাসপাতাল থেকে স্যালাইন কেনার এনওসি দেওয়া হয়। বর্তমানে হাসপাতাল থেকে স্যালাইন কিনে রোগীদের সরবরাহ করা হচ্ছে।

মিটফোর্ড হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আব্দুর রশিদ সমকালকে বলেন, চাহিদার তুলনায় খুবই কম পরিমাণ স্যালাইন সরবরাহ করা হচ্ছে। তা ছাড়া যে পরিমাণই সরবরাহ করা হোক না কেন, তাতে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন সমকালকে বলেন, ঢাকা মেডিকেলের চাহিদার মাত্র ১৫ শতাংশ স্যালাইন জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সরবরাহ করতে পারে। বাকি ৮৫ ভাগ স্যালাইন দরপত্রের মাধ্যমে কেনা হয়। কিন্তু চলতি বছর প্রতিষ্ঠানটি কোনো স্যালাইনই সরবরাহ করতে পারেনি। তাই দরপত্রের মাধ্যমে স্যালাইন কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। তবে সরবরাহ না থাকায় মাঝে মাঝে রোগীদেরই স্যালাইন কিনতে হয়।

http://www.samakal.com/todays-print-edition/tp-first-page/article/1809660/