৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, সোমবার, ২:০৬

কৃষিতে শ্রমিক সঙ্কট

এক বছরে কমেছে ৭ লাখ

দেশের কৃষি খাতে শ্রমিক সঙ্কট ক্রমে তীব্র আকার ধারণ করছে। শ্রমিক সঙ্কটের কারণে ধান চাষে দিন দিন আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেক জমির মালিক ও কৃষক। শুধু ধান চাষ নয়, পোলট্রি, মাছ চাষসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষি উদ্যোগ ভবিষ্যতে সঙ্কটের মুখে রয়েছে কৃষি খাত থেকে শ্রমিকদের চলে যাওয়ার কারণে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী গত এক বছরে কৃষি খাতে শ্রমিক কমেছে সাত লাখেরও বেশি। এ সঙ্কট মোকাবেলা করতে না পারলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়াসহ এ খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে।

অধিক উপার্জন আর উন্নত জীবনের আশায় কৃষি খাত ছেড়ে ক্রমে শহরমুখী হচ্ছে মানুষ। যোগ দিচ্ছে বিভিন্ন শিল্প কারখানাসহ নানা ধরনের পেশায়। অনেকে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। অনেকে ুদ্রঋণসহ বিভিন্ন ভাবে অর্থ জোগাড় করে নিজেই উদ্যোগী হয়ে কিছু করার চেষ্টা করছে। এভাবে শিল্প, সেবাখাতসহ বিভিন্ন অকৃষি খাতে শ্রমিকদের স্থানান্তর কৃষিতে শ্রমিক সঙ্কটের প্রধান কারণ।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী দেশে এক দিকে রয়েছে চার কোটি ৮২ লাখ বেকার। কাজের সন্ধানে লাখ লাখ তরুণ এমনকি নারীরাও বিদেশে পাড়ি জমাতে মরিয়া। রাজধানী ঢাকায় গিজগিজ করছে মানুষ। আরেক দিকে গ্রামে ক্ষেত-খামারে কৃষিসহ বিভিন্ন কাজের জন্য উচ্চ মজুরি দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।
কয়েক বছর ধরে ধান কাটার মওসুমে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না মর্মে নিয়মিত খবর প্রকাশিত হচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় মাঠের পর মাঠ জুুড়ে পাকা ধান পড়ে থাকে কিন্তু সময়মতো ধান কাটার লোক পাওয়া যায় না। ফলে কৃষক সময়মতো ধান ঘরে তুলতে পারছেন না। ফলে পাকা ধান তলিয়ে যাওয়া, মাঠেই ধান ঝরে পড়ার ঘটনাও ঘটছে। ধান কাটার মওসুম এলে অনেক এলাকায় কৃষকদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় শ্রমিক সঙ্কট। এ পরিস্থিতিতে কৃষক বা জমির মালিক অতিরিক্ত মজুরিতে শ্রমিক রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে অনেক সময় উচ্চ মজুরি দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যায় না। ধানের বাম্পার ফলন হলেও আজকাল কৃষকের আনন্দ ম্লান হয়ে যায় শ্রমিক সঙ্কট ও শ্রমিকদের উচ্চ মজুরির কারণে। অনেক এলাকায় তিন বেলা খাবার এবং দৈনিক ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দিতে হয় শ্রমিকদের ধান কাটার মওসুমে। ধান চাষ, জমি থেকে ধান কেটে বাড়িতে পৌঁছানোর পরও তা থেকে খাদ্য উপযুক্ত চাল প্রস্তুত করতে বিভিন্ন পর্যায়ে যে খরচ এবং শ্রম দরকার তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে লাভজনক হয় না কৃষক ও জমির মালিকদের জন্য।

নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার রয়েলবাড়ি ইউনিয়নের পুরানবাড়ি গ্রামের কৃষক জিয়াউল ইসলাম বকুল বলেন, সর্বশেষ বোরো মওসুমে তাদের এলাকায় প্রতি কাঠায় ৬ থেকে ৮ মণ করে ধান উৎপাদিত হয়েছে। তাদের এলাকায় ১০ শতাংশে এক কাঠা। ধান কাটার শ্রমিক খরচসহ প্রতি কাঠায় খরচ পড়ে তিন হাজার টাকার ওপরে। আর ধানের মণ বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায়।
তিনি বলেন, এক কাঠায় যদি ৭ মণ ধান হয় তাহলে ৫০০ টাকা মণ হিসেবে বাজারমূল্য দাঁড়ায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। ধান বাড়িতে আনার পর মাড়াই করা, সিদ্ধ করা, শুকানো, ধান ভাঙানোসহ প্রতিটি পর্যায়ে কঠোর পরিশ্রম এবং খরচ আছে। এসব হিসাব করলে ধান চাষে লাভ হয় না।
তারপরও কেন ধান চাষ করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়িতে গরু আছে। গরুর জন্য খড়, ধানের কুড়া দরকার হয়। নিজেদের খোরাকির জন্য চাল দরকার। আর আমি আমাদের নিজের জমি চাষ করি। নিজের জমি রেখে আমি তো অন্য কাজ করতে পারি না। যারা নিজের জমি নিজে চাষ করতে পারে তাদের কিছু লাভ হয়। লেবার দিয়ে চাষ করলে লাভ থাকে না।
জিয়াউল ইসলাম বলেন, তাদের শ্রমিক সঙ্কট মারাত্মক। বৈশাখ মাসে তাদের এলাকায় একজন শ্রমিক দিনে এক হাজার থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত দাবি করে। তাই অনেকে জমির ধান কাটার জন্য কাঠাপ্রতি চুক্তি করে। সাধারণত এক কাঠা জমির ধান কাটতে ৫০০ টাকা লাগে। বর্ষাকাল হলে এবং জমিতে পানি থাকলে আরো বেশি লাগে। তিনি বলেন, এক কাঠা জমির ধান কাটতে একজন শ্রমিকের সকাল থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত লাগে সাধারণত।

জিয়াউল ইসলাম বকুল বলেন, সরকার তো আমাদের খোঁজ নেয় না। আমাদের এলাকায় ধানের মণ সরকার ৮০০ টাকা নির্ধারণ করেছে শুনেছিলাম এবার বোরো মওসুমে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ধান কেনে। বাজারে ধান নিলে ৪০০, ৫০০ টাকা মণ বলে তারা। ভালো ধান হলে ৬০০ টাকা। এর বেশি দামে বিক্রি করা যায় না।

পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠী উপজেলার সোহাগদল গ্রামের রাসেল দুই বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন। তিনি জানান, এখন তার ভালো আয় হচ্ছে। কোনো কোনো দিন এক হাজার টাকারও বেশি থাকে। কৃষি কাজ ছেড়ে কেন ঢাকা এলেন জানতে চাইলে রাসেল বলেন, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কাদা পানিতে কাজ করতে হতো আগে। যে পরিমাণ কষ্ট সে পরিমাণ মজুরি পাওয়া যায় না। তা ছাড়া সব সময় কাজও থাকে না। এভাবে জমিতে কাজ করলে জীবনে উন্নতির কোনো আশা নেই। তাই গ্রাম ছেড়ে ঢাকা এসেছি।

সারা দেশেই রাসেলের মতো অনেকে কৃষিকাজ ছেড়ে কেউ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, কেউ শহরে বা গ্রামে রিকশা বা ইজিবাইক চালাচ্ছে, কেউ গার্মেন্ট বা জুতার কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। আবার কেউ ডক ইয়ার্ডে, কেউ নির্মাণ শিল্পে কাজ করছে।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কৃষি খাতে নিয়োজিত ছিল দুই কোটি ৫৩ লাখ ৯৮ হাজার শ্রমিক। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাতে নিয়োজিত ছিল দুই কোটি ৪৬ লাখ ৯৩ হাজার শ্রমিক। এক বছরে এ খাতে শ্রমিক কমেছে সাত লাখ পাঁচ হাজার।
সঙ্কট মোকাবেলায় করণীয় : কৃষিতে শ্রমিক সঙ্কট মোকাবেলা এবং শহরমুখী মানুষের স্রোত ঠেকাতে গ্রামমুখী উন্নয়ন নীতি, উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগের প্রফেসর ড. আবদুল মোমেন মিঞা বলেন, ধানের উৎপাদন ধরে রাখা এবং কৃষিতে শ্রমিক সঙ্কট মোকাবেলায় কৃষিতে ভর্তুকি বৃদ্ধির পাশপাশি যান্ত্রিকীকরণ দরকার।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগের প্রফেসর পরেশ চন্দ্র মোদক বলেন, সরকার তিন তিনবার কৃষি নীতি করেছে কিন্তু তাতে কৃষকের মূল্যায়ন হয়নি। কৃষিতে শ্রমিক সঙ্কট মোকাবেলায় শ্রম শক্তি উপযুক্ত ব্যবহারের নীতি গ্রহণ করতে হবে। কৃষক যাতে ফসলের উপযুক্ত দাম পায় সে জন্য বাম্পার ফলনের সময় ফসল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, মানুষের শক্তিই হলো আসল। একে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। মানুষকে গ্রামে ফেরানোর নীতি গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে কোটি কোটি মানুষ বেকার রেখে যন্ত্রনির্ভর হলে মানুষ এক সময় বিদ্রোহ করবে।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রামীণ সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. ওয়াকিলুর রহমান বলেন, কৃষিতে শ্রমিক সঙ্কটের যেসব কারণ রয়েছে তা অযৌক্তিক নয়। মানুষ যত বেশি শিক্ষিত হবে, যত বেশি শিল্পায়ন, নগরায়ন হবে ততই ধান চাষের মতো কৃষি ক্ষেত্রে মানুষের কাজের আগ্রহ কমবে। একজন শিক্ষিত মানুষ তার নিজের জমিতেও সরাসরি চাষ করতে হয়তো সঙ্কোচ বোধ করবেন কিন্তু তিনিই আবার সেই জমিতে পোলট্রি ফার্ম, মাছ চাষ বা ফলের চাষ করতে লজ্জা পাবেন না। এটা পরিচয় সঙ্কটের ইস্যু। কৃষিতে শ্রমিক সঙ্কট মোকাবেলায় ধান চাষে অধিকতর ভর্তুকি প্রদান ও যান্ত্রিকীকরণের পরামর্শ দেন তিনি।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/345786