দূষণে দুর্বিষহ ঢাকাবাসী। ঢাকার শ্যামপুর এলাকা থেকে তোলা ছবি : নাসিম সিকদার
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, সোমবার, ২:০৫

ঢাকায় দুঃসহ দূষণ

ভয়াবহ বায়ুদূষণের কবলে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা বিশে^ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এই ইনডেক্স দৈনিক বিশ্বের বিভিন্ন শহরের বায়ুর গুণাগুণ পরীক্ষা করে। ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষিত হয়েছে। শ^াস-প্রশ^াস প্রক্রিয়ায় বায়ুর সাথে মিশ্রিত বিভিন্ন দূষিত পদার্থ ফুসফুসে গিয়ে নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি করে থাকে। পরিবেশ অধিদফতরের গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় বায়ুদূষণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ঢাকায় বছরে ১৫ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়ে থাকে।

রাজধানীতে ২৪ ঘণ্টায় প্রতি ঘনমিটার জায়গায় এসপিএম মিশে ২০০ মাইক্রোগ্রাম। এটা জাতীয় মানদণ্ডের চেয়ে দ্বিগুণ এবং বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মানের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। অপর দিকে বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বাতাসে ২৪ ঘণ্টায় ১০০ কেজি সিসা, তিন হাজার ৫০০ কেজি এসপিএম, এক হাজার ৫০০ কেজি সালফার-ডাই অক্সাইড, ১৪ টন হাইড্রোজেন কোরাইড ও ৬০ টন কার্বন মনোক্সাইড মেশে। এসব রাসায়নিক পদার্থ মানবস্বাস্থ্যের ভয়াবহ ক্ষতি করে যাচ্ছে। এসব ক্ষতিকর পদার্থ ঢাকার বাতাসে মিশছে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি, কলকারাখানা, ইটের ভাটায় ইট পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়ার মাধ্যমে এবং হাসপাতালের অনিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে। এমনকি ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ মিশে যাচ্ছে অনিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশনের কারণেও।

যানবাহনের মধ্যে পরিবেশ দূষণ করে থাকে ট্রাক, কয়েক প্রকারের বাস, ডিজেলচালিত অন্যান্য যানবাহন এবং টু-স্ট্রোকের মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য বাহন।
বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের তথ্য অনুসারে, রাজধানীতে শুধু ট্রাক থেকে কার্বন-মনোক্সাইড নিঃসরিত হয় ১৩.৪ শতাংশ, হাইড্রোজেন কোরাইড ৮.৬, নাইট্রোজেন অক্সাইড ৫৯.৭ এবং পার্টিকেল পলিউশন (পিএম) ৪৭.৫ শতাংশ। বাস থেকে কার্বন-মনোক্সাইড নিঃসরিত হয় ১০.৩ শতাংশ, হাইড্রোজেন কোরাইড ৯.৭, নাইট্রোজেন অক্সাইড ১৮.৫ এবং পার্টিকেল পলিউশন (পিএম) ২৯.৪ শতাংশ। মিনিবাস থেকে কার্বন-মনোক্সাইড নিঃসরিত হয় ৭.৩ শতাংশ, হাইড্রোজেন কোরাইড ৩.৯, নাইট্রোজেন অক্সাইড ৬.৫ এবং পার্টিকেল পলিউশন (পিএম) ১৯.১ শতাংশ। অন্যান্য যানবাহন থেকে কার্বন-মনোক্সাইড নিঃসরিত হয় ৩৮.২ শতাংশ, হাইড্রোজেন কোরাইড ১৮.২, নাইট্রোজেন অক্সাইড ৬.৫ এবং পার্টিকেল পলিউশন (পিএম) ১.২ শতাংশ।
বায়ুদূষণসহ অন্যান্য পরিবেশদূষণের কারণে রাজধানীসহ বাংলাদেশের মানুষ নানা ধরনের রোগে ভুগছে। এর মধ্যে কার্ডিওভাস্কুলার (হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি) রোগ, অ্যাজমা (হাঁপানি), বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া এবং আইকিউ হ্রাস পাওয়ার মতো নানা ধরনের অসুস্থতায় ভুগছে।

শুধু কলকারখানা ও যানবাহন নয়, অনিরাপদ হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। হাসপাতালে ব্যবহৃত সুই ও রক্ত ব্যবহার করে রক্তসহ ব্যাগ, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, গজ-ব্যান্ডেজ, মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ইত্যাদি উন্মুক্ত স্থানে ফেলে দেয়া হচ্ছে। এসব বর্জ্য থেকে পরিবেশে রাসায়নিক পদার্থ মিশে পরিবেশ দূষণ করছে। ঢাকার আকাশে প্রতিদিন মিশে যাচ্ছে প্রচুর অ্যামোনিয়া গ্যাস। এই অ্যামোনিয়া মিশছে খোলা আকাশের নিচে ত্যাগ করা মল-মূত্র থেকে।
ফুসফুসের রোগসহ নানা ধরনের রোগের জন্য দায়ী অ্যামোনিয়া গ্যাস। ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর মাত্রার চেয়ে ৫১.৬ শতাংশ বেশি অ্যামোনিয়া গ্যাস ভাসছে। এই গ্যাস মল-মূত্রের সাথে ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত সার থেকে পরিবেশে মিশে যাচ্ছে। বাতাসে মিশ্রিত অ্যামোনিয়া গ্যাস পরিমাণের দিক থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সবচেয়ে বেশি (৭৩.৩ শতাংশ) রয়েছে। ঢাকা রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে (৫১.৬ শতাংশ) এবং কলকাতা তৃতীয় অবস্থানে (৪৭.১ শতাংশ)। মল-মূত্র ও সার থেকে বায়ুবাহী ক্ষতিকর কণা তৈরি হচ্ছে এবং তা ফুসফুসে গিয়ে ক্ষতি করছে।

বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা বিশে^ পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। প্রথম অবস্থানে রয়েছে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক, দ্বিতীয় চীনের রাজধানী বেইজিং, তৃতীয় আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্সআয়ার্স, চতুর্থ দিল্লি এবং পঞ্চম ঢাকা। নাসার উপগ্রহ ‘অরা’য় স্থাপন করা ট্রপোস্ফেরিক ইশিন স্পেকট্রোমিটার যন্ত্রের মাধ্যমে ২০১৩ সাল থেকে বায়ুদূষণের এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
গ্লোবাল এনভায়রন ইনডেক্স অনুসারে রাজধানীতে কার্বন রয়েছে গ্রহণযোগ্য ২৯০-৩০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) মাত্রার চেয়ে ৫০ বেশি। অর্থাৎ ঢাকায় কার্বনের পরিমাণ ৩৫০ পিপিএম। এসব পিপিএম আসছে ঢাকার কাছের ইট ভাটা থেকে ও পুরনো গাড়ির ধোঁয়া থেকে। এসব গাড়ি জ্বালানি পুরোপুরি পোড়াতে পারে না, পার্টিকল আকারে বাতাসে ছেড়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া পিপিএম আসছে শিল্প-কারখানার ধোঁয়া ও বিষাক্ত পদার্থ বাতাসে ছেড়ে দেয়ার কারণে এবং রাস্তা সংস্কারের ফলে নির্গত ধোঁয়া ও অন্যান্য উপায়ে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) আবদুল মতিন বলেন, বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ ধুলাবালু, কলকারাখানা, যানবাহন ও হাসপাতাল বর্জ্য। বিশে^র অন্যান্য দেশ বায়ুদূষণ হ্রাসে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও বাংলাদেশে তা শুধু কথামালা ও কাগজেই সীমাবদ্ধ। বায়ুদূষণ রোধে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে না পারলে রাজধানীবাসী তথা পুরো দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতেই থাকবে।
ফুসফুসের অ্যালভিওলি অক্সিজেনের চেয়ে কার্বন মনোক্সাইড ৩০০ গুণ বেশি দ্রুত শোষণ করে। রক্তে উচ্চ ঘনত্বের কার্বন মনোক্সাইড মিশ্রণের কারণে বিভিন্ন আর্টারিতে রক্ত পাম্প করতে হৃৎপিণ্ডের অনেক বেশি কসরত করতে হয়। নাইট্রোজেন অক্সাইড শ^াস-প্রশ^াসজনিত সিস্টেমকে ধীরে ধীরে অকার্যকর করে দেয়। হাড় ও কোষে সিসা জমে এক সময় ব্রেইন ও কিডনির বেশি ক্ষতি করে থাকে। সিসার ক্ষতিকর প্রভাব শিশুদের স্নায়ুবিক পদ্ধতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। ডিজেল ইঞ্জিন থেকে সাসপেডেন্ড পার্টিকুলেট মেটার (এসপিএম) নির্গত হয়ে থাকে। এই এসপিএম ‘শুট’ নামক এক ধরনের রাসায়নিক তৈরি করে যেটি দৃষ্টিশক্তি কমিয়ে দেয়। এ ছাড়া ইঞ্জিন পুরোপুরি পোড়াতে না পেরে কিছু হাইড্রোকার্বন ছেড়ে দেয়। হাইড্রোকার্বন কণা ফুসফুসের মাধ্যমে দেহে গিয়ে শিশুদের স্নায়ু বৈকল্যের সৃষ্টি করে থাকে।
রাজধানীর বাতাসে একদিনে জমা হয়
১০০ কেজি সিসা
৩৫০০ কেজি এসপিএম
১৫০০ কেজি সালফার ডাই অক্সাইড
১৪ টন হাইড্রোজেন কোরাইড
৬০ টন কার্বন মনোক্সাইড
সুত্র : বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি কমিশন

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/345791