৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, সোমবার, ২:০৪

অর্থ পাচারে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে অর্থনীতি

আমদানি ব্যয় রেকর্ড পরিমাণ বাড়লেও বাড়ছে না রপ্তানি আয়। আর এতে বেড়েই চলছে বাণিজ্য ঘাটতি। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর (জুলাই-জুন) শেষে সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থাৎ গত এক বছরে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে ৯৩ শতাংশ। আর এ সময়ে আমদানি হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা। যা পুরো অর্থবছরের বাজেটের চেয়েও এক লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,অর্থ পাচারে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে দেশের অর্থনীতি।
এ সময় বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮২৬ কোটি ডলার। যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি তার আগের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ সময় পণ্য ও সেবা উভয় বাণিজ্যেই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮২৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে যার পরিমাণ ছিল ৯৪৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে ৯২ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামো উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্পগুলোর জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করা হচ্ছে। ফলে ব্যাপক হারে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি আয় বাড়ছে না। তাই বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে করে বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা উদ্যোগ নিলেও ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।
তাদের মতে, উৎপাদনশীল খাতে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়। যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। কিন্তু দেখতে হবে আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা। কারণ ভবিষ্যতে অর্থপাচরের ফলাফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।

তাদের আশঙ্কা, বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে চাপের মুখে পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কারণ আমদানি বাড়লে ডলারের দাম বাড়ে। যার প্রভাব পড়ে আমদানি ও শিল্পপণ্যের দামে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশে অবকাঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে। মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করা হচ্ছে। এ কারণে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি আয় বাড়ছে না। তাই ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। তাই এখন রপ্তানি আয় বাড়াতেই হবে। এর বিকল্প নেই।
তবে আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, যদি মূলধনী যন্ত্রপাতি বা পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি হয়ে থাকে তাহলে ভালো। কিন্তু আমদানির এই প্রভাব বিনিয়োগ খাতে দেখা যাচ্ছে না। তাই আমদানির নামে অর্থপাচার হচ্ছে কি না তা সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখতে হবে। যদি পাচারই হয়ে থাকে তাহলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে দেশের অর্থনীতি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে ইপিজেডসহ রপ্তানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৩ হাজার ৬২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় করেছে ৫ হাজার ৪৪৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮২৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা এক লাখ ৫৩ হাজার ৩৬৭ কোটি
টাকার বেশি।
এই সময়ে, আমদানি বেড়েছে ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। এর বিপরীতে রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অন্যদিকে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ফলে চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়েছে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে বাংলাদেশে ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো।
কিন্তু গত কয়েক বছর উদ্বৃত্তের ধারা অব্যাহত থাকলেও গত অর্থবছরে ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে। যা এখনো অব্যাহত আছে। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে ৯৭৮ কোটি ডলার ঋণাত্মক হয়েছে। কিন্তু এর আগের ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ঋণাত্মক ছিল ১৩৩ কোটি ১০ লাখ ডলার।
তিনি বলেন, আমদানির উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিট বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধিকে ঋণাত্মক ধারায় এনেছে। এর প্রভাবে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবে এবং সামগ্রিক ভারসাম্যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কিছুটা কমেছে।

প্রতিবেদন মতে, আলোচিত সময়ে সেবা খাতে বেতনভাতা বাবদ বিদেশীদের পরিশোধ করা হয়েছে ৯১১ কোটি ডলার। বিপরীতে বাংলাদেশ এ খাতে আয় করেছে মাত্র ৪৫৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৫৭ কোটি ডলার। যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩২৮ কোটি ডলার।
বিদেশ থেকে ধারের পরিমাণও বেড়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশী ঋণ গ্রহণ বেড়েছে। আলোচ্য সময়ে আর্থিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের ঋণ এসেছে ৫৭৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা আগের একই সময়ের তুলনায় ৭৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি। বিদেশী ঋণ বাড়লেও বিদেশী বিনিয়োগ কমে এসেছে।

এ সময় সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ২৭৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ কম। অন্যদিকে শেয়ারবাজারে বিদেশী বিনিয়োগও কমেছে। অর্থবছর শেষে শেয়ারবাজারে ৩৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে। যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ৪৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ আমদানি হয়েছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা। যা পুরো অর্থবছরের বাজেটের চেয়েও এক লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় হয়েছে পাঁচ হাজার ৮৮৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় চার লাখ ৯৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রসঙ্গত, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে সংশোধিত বাজেটের আকার নামিয়ে করা হয় তিন লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অস্বাভাবিকভাবে আমদানি ব্যয় বাড়ায় বাংলাদেশকে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়তে হতে পারে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে ছয় হাজার ৯৪২ কোটি ২১ লাখ ডলারের (বা পাঁচ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকার)।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, অস্বাভাবিকভাবে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া ও রফতানি আয় কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশকে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়তে হবে।
তিনি বলেন, এখনই এই চাপ সহ্য করতে হচ্ছে। আগামীতে এই চাপ আরও বাড়বে। এর ফলে ক্রমে বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।
আহসান এইচ মনসুরের মতে, আমদানি ব্যয় মেটাতে যে পরিমাণ টাকা লাগবে, সেই টাকা থাকলে সমস্যা হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো কতদিন এভাবে চলবে? সেটাই দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, অনেক সময়ই আমরা শুনি, এক পণ্য আমদানির নামে অন্য পণ্য আমদানি হচ্ছে। অনেক সময় শূন্য কন্টেইনারও আসে। আবার ওভার ইনভয়েসের (আমদানি করা পণ্যের বেশি মূল্য দেখিয়ে) মাধ্যমে অর্থ পাচার করছেন অনেকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট বা এলসি) খোলার ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। গত অর্থবছরে এলসি খোলায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ১১ শতাংশের মতো। এ হিসাবে এলসি খোলায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় চার গুণ। এই সময়ে খাদ্যপণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও জ্বালানি তেলের এলসি খোলার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের এলসি খোলার হার, প্রায় ১৪৪ শতাংশ।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. জায়েদ বখত বলেন, যদি মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ে, তাহলে সেটা অর্থনীতির জন্য অনেক ভালো খবর। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা হয়তো এখন বিনিয়োগে মনোযোগ দিচ্ছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পসহ বড় বড় প্রকল্প বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা এনে দিয়েছে, যা শিল্পায়নে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

http://www.dailysangram.com/post/343974