২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১১:০৯

প্রাণহানি বাড়লেই বাড়ে তোড়জোড়

সড়ক নিরাপত্তায় নেওয়া সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় না

সড়কে প্রাণহানি বাড়লে দুর্ঘটনা রোধে তোড়জোড় শুরু হয়। নড়েচড়ে বসে মন্ত্রণালয় এবং সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা ও কমিটি। দফায় দফায় সভা বসে। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয় না। বৈঠকের টেবিল থেকে ঘুরে ফিরে আসে সেই পুরনো সিদ্ধান্তগুলোই। এসব বাস্তবায়নে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। সড়ক নিরাপত্তায় বাড়ে কড়াকড়ি। তবে কয়েক দিন যেতে না যেতেই আবার জেঁকে বসে অনিয়ম। দুর্ঘটনা রোধে নেওয়া সিদ্ধান্ত গড়াগড়ি খায় রাস্তায়। দীর্ঘমেয়াদে আর কার্যকর থাকে না। এভাবেই বছরের পর বছর চলছে দেশের পরিবহন খাত।

পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তাদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতে মন্ত্রণালয়কে সহায়তায় রয়েছে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। সড়ক নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ এ ফোরামের সদস্য সংখ্যা ৪৪। ছয়জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, ১১ জন সচিব, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের শীর্ষ নেতা এবং বিশেষজ্ঞরা কাউন্সিলের সদস্য।
সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর নেতৃত্বে 'সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদ' রয়েছে। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ আইনের বলে গঠিত এ পরিষদও দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থার দেখভালে রয়েছে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। মহানগর ও জেলা পর্যায়ে রয়েছে আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সড়ক নিরাপত্তা কমিটি কাজ করে। এর বাইরেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের নেতৃত্বে রয়েছে আরেকটি কমিটি।
এত নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকার পরও সড়কে দুর্ঘটনা কমছে না। বন্ধ হচ্ছে না নৈরাজ্যও। পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা চলছেই। গতকাল বুধবার সড়কে প্রাণ গেছে অন্তত ছয়জনের। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও কার্যকর হয় না। গত জুনে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা নির্দেশনা দেন। এর আগে ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে সভা থেকে দেওয়া হয়েছিল ২৯ দফা নির্দেশনা। সেগুলোও কার্যকর হয়নি।

তাছাড়া সংশ্নিষ্ট কমিটিগুলোর সভাও হয় না ঠিকমতো। ছয় মাস অন্তর জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেখানে গত চার বছরে হয়েছে মাত্র তিনটি। শেষ সভা হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে। সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদের সভা হওয়ার কথা চার মাস অন্তর। গত সোমবার পরিষদের ৪২তম সভা হয়েছে ১০ মাস বিরতিতে।

সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতে ২০১২ সালের জুলাইয়ে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বিশেষজ্ঞ উপ-কমিটি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ৮৬টি সুপারিশ করে। মহাসড়কের ব্ল্যাক স্পট দূর করা ছাড়া আর কোনো সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হয়নি। মহাসড়কে বাসের সর্বোচ্চ গতি ৮০ কিলোমিটার, পণ্যবাহী যানবাহনের গতি ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বাস্তবায়ন হয়নি মহাসড়কে অবৈধ যানবাহন ও তিন চাকার ধীরগতির গাড়ি চলাচল বন্ধের নির্দেশনা।
ছয় বছরের আগের সিদ্ধান্তগুলোই গত সোমবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আবারও নেওয়া হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কঠোর হওয়ার ঘোষণা এসেছে। গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ৪১তম সভা থেকেও একই ঘোষণা এসেছিল। দুর্ঘটনা রোধ ও সড়ক রক্ষায় অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল বন্ধে কঠোর হওয়ার ঘোষণা আগেই এসেছিল। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এসবের কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি।
২০১৫ সালে ১ আগস্ট ঘোষণা দিয়ে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে তিন চাকার অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। জোরেশোরে শুরু হয় তিন চাকার যান চলাচল বন্ধে অভিযান। কিন্তু কয়েকদিন না যেতেই অভিযানের গতি কমে যায়। মহাসড়কে ফিরে আসে অটোরিকশা। এবার কি ইতিবাচক কিছু হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলছেন, 'হ্যাঁ।' তিনি সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল ও উপদেষ্টা পরিষদ উভয় কমিটির সদস্য সচিব। অবৈধ যান চলাচল ও মহাসড়কে ধীরগতির যান চলাচল বন্ধ করাসহ সব সিদ্ধান্তই পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন দূরপাল্লার গাড়িতে একাধিক চালক রাখতে হবে। একজন চালক একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি বাস চালাতে পারবেন না। চালকদের জন্য মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণ করতে হবে। চালক ও যাত্রীর জন্য সিটবেল্ট এবং পথচারী পারাপারে জেব্রাক্রসিং থাকতে হবে। ঢাকা উত্তর সিটিতে জেব্রাক্রসিং অঙ্কন ছাড়া আর কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। তবে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেছেন, বাসে একাধিক চালক রাখা, সিটবেল্ট স্থাপনে মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) গবেষণা অনুযায়ী, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত যানবাহনের কারণে মহাসড়কে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। সাম্প্রতিক কয়েকটি দুর্ঘটনার জন্য এ বাহনগুলো দায়ী। এবারের ঈদযাত্রায় সড়কে প্রাণহানির জন্য এসব বাহনকে দায়ী করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত মঙ্গলবার তিনি বলেন, মহাসড়কে এসব অবৈধ যান চলতে দেওয়া হবে না।
তবে এ ঘোষণা নতুন নয়। এর আগেও কয়েক দফা সিদ্ধান্ত হয়েছিল- সড়কে অবৈধ যানবাহন চলতে পারবে না। ২০০৮ সালে উচ্চ আদালত রায় দেন নছিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইকের মতো নিবন্ধনহীন যানবাহন রাস্তায় চলতে পারবে না। ইজিবাইক চলতে আইনি বাধা থাকলেও আমদানি বন্ধ নেই এই বাহনটির। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় বন্ধ করতে চাইলেও সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা ইজিবাইকের পক্ষে। তাদের যুক্তি এসব গাড়ি চলাচল বন্ধ হলে দুর্ভোগ বাড়বে, লাখো চালক বেকার হবে।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, অন্তত ১৪ লাখ অবৈধ নছিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইক সড়কে চলছে। পরিবহন শ্রমিকদের যুক্তি- এসব গাড়ি বন্ধ হলে ১৫ লাখ লোক বেকার হবেন। সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদের ৪১তম সভার কার্যবিবরণীর তথ্য অনুযায়ী, ইজিবাইক আমদানি বন্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আধা-সরকারি পত্র দিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে বুয়েটের অধ্যাপক সামছুল হক সমকালকে বলেন, লাখ লাখ ইজিবাইক বৈধ পথেই আমদানি হয়েছে। যে গাড়ির সড়কে চলার অনুমতি নেই, তা আমদানি করতে অনুমতি দেওয়া হলো কেন? পরিবহন খাতের প্রতিটি কাজেই সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।

মহাসড়কে ধীরগতির যান চলাচল নিষিদ্ধের পর লেগুনা চলাচল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদ। কিন্তু সম্প্রতি লেগুনার কারণে দুটি বড় দুর্ঘটনা ঘটায় মহাসড়কে লেগুনা চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, সড়কে প্রাণহানি বেড়ে গেলেই তড়িঘড়ি করে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যথাযথ গবেষণা হয় না।

এবারের ঈদযাত্রায় সড়ক নিরাপদ রাখতে ৩৩ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। কিন্তু তার অধিকাংশই সড়কে কার্যকর হয়নি। নির্দেশনা উপেক্ষা করে মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন ও পণ্যবাহী যান চলেছে। লাইসেন্সবিহীন চালকও ছিল স্টিয়ারিংয়ে। গত ২৫ আগস্ট নাটোরে 'চ্যালেঞ্জার পরিবহনের' একটি বাস ও লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ যায় ১৭ জনের। বিআরটিএর তদন্ত অনুযায়ী, লেগুনাটি একটি ট্রাককে ওভারটেক করতে গিয়ে বাম লেন ছেড়ে ডানে চলে আসে। চ্যালেঞ্জার পরিবহনের বাসটির ফিটনেস ছিল না। ২৫ আগস্ট মহাসড়কে ট্রাক চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। নিয়ম না মানার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। গত ২০ আগস্ট নরসিংদীর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নোয়াকান্দিতে বাসের সঙ্গে লেগুনার সংঘর্ষ হয়। বাসটির ফিটনেস মেয়াদ পার হয়েছে ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ। লেগুনার ফিটনেসের মেয়াদ শেষ হয় গত ২৪ এপ্রিল। লেগুনাটির রুট পারমিটও ছিল না। লাইসেন্স ছিল না লেগুনা চালকের।

জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ সমকালকে বলেন, এসব ঘটনাই প্রমাণ করছে ধীরগতির গাড়ি, ফিটনেসবিহীন যান চলাচল মহাসড়কে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা রাস্তায় কার্যকর হয়নি। বাস্তবায়ন না হলে হাজারো সিদ্ধান্ত নিয়েও কোনো লাভ নেই।
মহাসড়কের পাশে যেখানে সেখানে পার্ক করা, অবৈধ বাজার বসাও বন্ধ হয়নি। উচ্ছেদ হয়নি অবৈধ দখল। রাজধানীর পথ থেকে ফিটনেসহীন যানবাহন উচ্ছেদে গত আট বছরে অন্তত ছয়বার অভিযান চালানো হয়। কিন্তু প্রতিবারই শ্রমিকদের আন্দোলনে অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। হুটহাট করে যাত্রী ওঠানামাও বন্ধ হয়নি। ঈদের আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটি ১৭ দফা নির্দেশনা জারি করে। যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানামা ঠেকাতে দরজা বন্ধ করে বাস চালানোর নির্দেশনা দিলেও তা কার্যকর হয়নি।

রাজধানীতে অনিরাপদ সড়কের অন্যতম প্রধান কারণ যাত্রী পেতে বাসে বাসে প্রতিযোগিতা। এ কারণেই গত ২৯ জুলাই জাবালে নূর বাসের চাপায় নিহত হন দুই কলেজ শিক্ষার্থী। নিহত দুই শিক্ষার্থীর সহপাঠীরা রাস্তায় নেমে এলে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
যাত্রী পেতে বাসে বাসে প্রতিযোগিতার জন্য চুক্তিতে বাস চালানোকে দায়ী করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। আন্দোলনের মধ্যে গত ৯ আগস্ট বাস মালিকরা ঘোষণা দেন আর চুক্তিতে বাস চলবে না। গত সোমবার সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদও সিদ্ধান্ত নেয়, চুক্তিতে বাস চালাতে দিতে পারবেন না মালিকরা। কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে, অধিকাংশ বাস এখনও চুক্তিতে চলছে। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সমকালকে বলেন, কয়েক বছর ধরে চলে আসা অনিয়ম মাত্র তিন সপ্তাহে বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে তারা তৎপর আছেন। চুক্তিতে চালানোয় পাঁচটি বাস কোম্পানির সদস্য পদ বাতিল হয়েছে।

 

http://www.samakal.com/bangladesh/article/180974