২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১০:৫৯

শেষ মুহূর্তে কোত্থেকে এলেন মিস্টার ইভিএম?

ড. মাহবুব উল্লাহ্

ইভিএমে ভোট দিচ্ছেন এক ব্যক্তি। ছবি-যুগান্তর
এ বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে, কারও কারও মতে ২০১৯-এর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হওয়ার কথা। এ নির্বাচনকে ঘিরে জনমনে অনেক ধরনের সংশয় ও সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছে। নির্বাচনটি সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচন হবে কিনা, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
বিএনপি ও তার জোটের দলগুলো মনে করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য যে ধরনের পরিবেশ থাকা দরকার সে ধরনের পরিবেশ এখনও দেখা যাচ্ছে না। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যে পরিবেশে সব দল ও মতের ভোটাররা স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। এটিও যথেষ্ট শর্ত নয়।
ভোটাররা যেভাবে ভোট দেন সেভাবেই ভোটের ফলাফলে তার প্রতিফলন ঘটবে সেটাও গণতন্ত্রকামী মানুষের আকাক্সক্ষা। আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে সেসব নির্বাচনের ফলাফল ভোটারদের মতামতের সঠিক প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে এমনটি অনেকেই মনে করেন না।
এর একটি বড় কারণ, এদেশে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে একটি মেরুদণ্ডসম্পন্ন সংস্থা হিসেবে দলীয় সরকার কিংবা সামরিক সরকার কাজ করতে দেয়নি।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্ব সাহসী ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হওয়াও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়ার একটি বড় কারণ। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব এমন কোনো প্রশাসনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই, যার ফলে নির্বাচন কমিশন নিজ উদ্যোগেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে। সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রণালী সম্পর্কে বিধি প্রণয়নেরও শর্ত দেয়া আছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজ পর্যন্ত কমিশন গঠনের বিধি বিধান তৈরি হয়নি। ফলে এক্সিকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন হয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশন এবং এর পূর্ববর্তী নির্বাচন কমিশন কার্যত এক্সিকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমেই গঠিত হয়েছে।
সার্চ কমিটি গঠন করে এই দুইবার নির্বাচন কমিশন গঠিত হলেও এতে মূলত শাসক দলের পছন্দেরই প্রতিফলন ঘটেছে। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত অন্যান্য নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই রাষ্ট্রপতি দিয়ে থাকেন।

দেশে এখন যে ধরনের অবিশ্বাস ও অনাস্থার পরিবেশ বিরাজ করছে, সেক্ষেত্রে সব মহলের আস্থা অর্জনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশন সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মত অনুযায়ী গঠিত হওয়াই কাম্য ছিল।
একটি দেশের কিছু কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সহমতের পন্থা ভিন্ন অন্য কোনো পন্থা অনুসরণ করা সমীচীন নয়। দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কেউ কখনও সহমত গঠনের পথে অগ্রসর হয়নি।
নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এখানেও দুর্ভাগ্যের বিষয়, এদেশে আমলাতন্ত্রকে ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber)-এর নীতি অনুযায়ী মেধা ও নৈর্ব্যক্তিকতার ভিত্তিতে গড়ে তোলা হয়নি। প্রশাসনকে দলীয়করণ করার নীতি সব ক্ষমতাসীন দলই কমবেশি অনুসরণ করেছে।
পরিস্থিতির এতই অবনতি ঘটেছে যে প্রশাসনের লোকেরাই ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বীকার করেন, ডিএনএ টেস্টে উত্তীর্ণ হতে না পারলে কারোর পক্ষেই পদোন্নতি পাওয়া কিংবা ভালো পোস্টিং পাওয়া সম্ভব নয়।
ছাত্রজীবনে কে কোন ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের পিতামাতা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা কোন দলের প্রতি অনুরক্ত এসব খোঁজখবর সংগ্রহ করেই পদোন্নতির তালিকা, এমনকি নিয়োগের তালিকাও স্থির করা হয় বলে অভিযোগ আছে। ফলে অনেক আমলাই হতাশায় ভোগে, এমনকি নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে।

এসব কারণে দেশের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেও দলমন্যতার অশুভ প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে বলেই অনেকের ধারণা। অথচ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ও আইন-কানুন মেনে নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনের সুযোগই একটি দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার শর্ত হওয়া উচিত। অন্য কোনো ধরনের আনুগত্য ও পক্ষপাতিত্ব দ্বারা আমলাতন্ত্রের মধ্যে কালিমা লেপনের সামান্যতম অবকাশ সৃষ্টি করা একেবারেই অসঙ্গত।

একদিকে যখন আমলাতন্ত্র দলীয়তার দোষে দুষ্ট হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ আছে, তার পাশাপাশি যদি নির্বাচনের সময় একজন দলীয় ব্যক্তি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী থাকেন, তখন সুষ্ঠু নির্বাচন কতটা দুরূহ হয়ে উঠতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এ রকম সমস্যা বিবেচনা করেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৯৯৫-৯৬ সালে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে।
শেষ পর্যন্ত এই দাবি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ রকম সরকারের অধীনেই ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব নির্বাচন পরাজিত পক্ষ প্রথমদিকে মেনে না নিলেও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলেই বিবেচিত হয়। সর্বোচ্চ আদালতে একটি মামলা হয়েছিল যাকে মুন সিনেমা মামলা বলে আখ্যায়িত করা হয়, সেই মামলার রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের মৌল কাঠামোবিরোধী বলে বাতিল করে দেয়া হয়।

আশ্চর্যের বিষয় হল, এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া হয়। এর ফলে দেশে রাজনৈতিক বিভাজন আরও প্রকট রূপ ধারণ করে। কারণ দেশের অনেক দলই মনে করে, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে এ ব্যবস্থা চালু থাকা বাঞ্ছনীয়।
যাই হোক, এখন পর্যন্ত সাংবিধানিকভাবে যে ব্যবস্থা চালু রয়েছে তাতে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা বিদ্যমান। শাসক দল বারবার বলছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, এর কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না।
এছাড়াও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে আরেকটি বড় বাধা হল বর্তমান সংসদ বহাল থাকা অবস্থাতেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা। অবশ্য সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার বিকল্পও সংবিধানে নির্দেশিত আছে। তবে বাস্তব অবস্থা এমন যে, সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে বিরোধী পক্ষের জন্য নির্বাচন করা কঠিন হবে, এমনকি অন্তর্দলীয় কোন্দলের জন্য সরকারি দলের পক্ষেও সুবিধাজনক হবে না।
এ রকম পরিস্থিতিতে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করাই সব পক্ষের জন্য স্বস্তিকর হবে। অন্যদিকে শাসক দলের নির্বাহী ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রেখে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা প্রায় অসম্ভব। কারণ নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন করার জন্য প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়।
একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে আরও অনেক বাধা বিদ্যমান। সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ এই কলামের পরিধির মধ্যে সম্ভব নয়। এতসব জটিলতার মধ্যে নতুন উপসর্গ যোগ করার প্রয়াস নিতে চলেছে নির্বাচন কমিশন। কমিশন অন্তত ১০০টি আসনে ইভিএমের ব্যবহার করতে চায়।
শেষ পর্যন্ত তারা যদি ইভিএম ব্যবহারের বিধির খসড়া প্রণয়ন করে সংসদীয় অনুমোদনের জন্য পাঠায়, তাহলে বর্তমান সংসদ হয়তো সে ব্যাপারে অনুমোদন দিয়ে ফেলতে পারে। একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপে আসা গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এখন শেষ সময়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন- ইভিএমের বিষয়টি সামনে এনে নতুন বিতর্ক তৈরি করছে।
যদিও বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে। ইসিও এতদিন বলে এসেছে সব দল না চাইলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি বা কারিগরি সামর্থ্যও এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি।

আগামী ৩১ অক্টোবর থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে। এ সময়ে ইসি কেন বা কার স্বার্থে ইভিএম নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে।’
ইভিএমের নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। একদিকে যখন একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য জটিল রাজনৈতিক বোঝাপড়া সম্পন্ন করা প্রয়োজন, তখন শেষ মুহূর্তে আরেকটি বিতর্ক কেন নির্বাচন কমিশন সৃষ্ট করছে তা বুঝে ওঠা অত্যন্ত কঠিন। এছাড়াও নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী ইভিএম সংগ্রহ করতে গেলে তিন হাজার পাঁচশ’ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সীমিতভাবে ইভিএম ব্যবহার করতে গিয়ে বেশকিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। দেশে যে মুহূর্তে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নটির কোনো সুরাহা হয়নি, তখন কেন এভাবে উটকো একটি ফ্যাকড়া সৃষ্টি করা হচ্ছে তা জনমনে এক বিশাল প্রশ্ন। ইসি প্রধান নিজেই বলেছিলেন, সর্বদিক দিয়ে সুষ্ঠু একটি নির্বাচন করা সহজ নয়।
নির্বাচন কমিশন প্রধান যখন নিজেই নিজের সংস্থার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না, তখন কী কারণে এবং কোন প্রণোদনায় এমন একটি ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে নির্বাচন কমিশন পা বাড়াচ্ছে তা যেমন বিতর্কিত, অন্যদিকে তেমনি তা জটিল পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তুলবে কিনা সেটা কি নির্বাচন কমিশন আদৌ ভাবছে?
অপরিণামদর্শিতা আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা একটি বড় সমস্যা। এ অবস্থায় শেষ মুহূর্তে ইভিএম প্রচলনের উদ্যোগ বিদ্যমান অপরিণামদর্শিতাকে আরও বিপজ্জনক করে তুলবে সে কথা কি নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞ সদস্যদের মাথায় আসে না?
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/85841