২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১০:৫৬

ইভিএমের তোড়জোড় কার স্বার্থে?

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : একটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির কল্যাণের জন্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন একান্ত অপরিহার্য হলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া দেশে বইতে না বইতে ইভিএম নিয়ে বিতর্ক বাধিয়াছে খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার। ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে কারও বিতর্ক নেই। তবে ইভিএমের মাধ্যমে ডিজিটাল কারচুপির ভয় রয়েছে। গ্রামেগঞ্জের মেলাতে এখনো পতুল নাচের খেলা একটি জনপ্রিয় খেলা। যে পতুলের প্রাণ নেই সেই পতুল নাচে আর গান গায়। যারা খেলা দেখেন তারা ভাবেন পতুল সত্যিই নিজে নিজে গান গাইছে আর নাচছে। এই নাচ দেখার জন্য মানুষ টাকা ব্যয় করে। অথচ একটুও ভাবে না ক্ষণিকের একটু আনন্দের উচ্ছ্বাস উপভোগ করতে গিয়ে অর্থের অপচয় করছে। পতুল নাচের ইতিহাস লিখা নিবন্ধনের উদ্দেশ্য নয়! নিবন্ধনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কেন ইভিএম নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে এই বিষয়টি পাঠকদের সামনে তুলে ধরা। মানুষের তৈরি প্রযুক্তিকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করা যায়। যেমন পতুলকে যিনি অপারেট করেন তিনিই একমাত্র জানেন কোন সুতার টানে পতুল নাচে। তেমনি ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট হলে যারা অপারেট করবে তারাই কেবল বলতে পারবে কার ভোট কার বাক্সে পড়বে। যারা অপারেট করবে তারা যদি নৈতিকতার মানদন্ডে উর্ত্তীণ না হন, তাহলে তাদের নিকট থেকে নিরপেক্ষতা আশা করা বোকামি। ইভিএমে কারচুপির সুযোগ নেই এটা ক্ষমতাসীনরা মনে করলেও প্রধান বিরোধীদল বিএনপি, জামাত সেটা মনে করে না। কারণ আন্তর্জাতিকভাবেও ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।

১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম ইভিএম পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। বর্তমানে বিশ্বের ৯০ শতাংশ দেশে এখন ইভিএম পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। যে কয়েকটি দেশে ইভিএম চালু করা হয়েছিল সে কয়টি দেশে এখন ইভিএম পদ্ধতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি পশ্চিমা দুনিয়ার কোন আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয় না। কারণ সেখানে ম্যানিপুলেশন বা কারসাজি করার সুযোগ থাকে। তারা যদি ব্যালট পেপারে ভোট করতে পারে তাহলে আমাদের ব্যালটে ভোট করতে বাধা কোথায়? ভারতের মতো দেশে ইভিএম পদ্ধতি বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছে দেশটির বিরোধী দল। এমনকি ভারতের আদালতে ইভিএম লইয়া একাধিক পিটিশন দাখিল করা হয়েছে। সম্প্রতি দেশটির কংগ্রেস দলের মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভি ইভিএমের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। তার ভাষ্যমতে কেবল তাহাদের দলই নহে, দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দলই মনে করে যত দ্রুত সম্ভব কাগজের ব্যালটে আবার ফিরাইয়া আনা উচিত। গত চার বছরে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে ইভিএম নিয়ে কারসাজির হাজারো অভিযোগ তুলেছে একাধিক বিরোধী দল। এমনকি যন্ত্র খারাপ হলেও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে সব ভোটই গিয়ে পড়েছে বিজেপির বাক্সে। এমন অভিযোগ বহুবার করেছে কংগ্রেস বা আম আদমি পার্টি। তবে ভারতে শেষ পর্যন্ত কী হবে তা স্পষ্ট করে কিছু না বলা গেলেও বাংলাদেশে ইভিএম চালু করার উদ্যোগ রহস্যজনক। পৃথিবীর যেই সকল দেশ ইভিএম পদ্ধতি চালু করেছিল তারা ইতিমধ্যে এই পদ্ধতি পরিত্যাগ করেছে। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ইভোটিং পরিত্যাগ করেছে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল কোর্ট ইভিএমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। একই বছরে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিমকোর্ট তাদের তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করেছে। নেদারল্যান্ডে ই-ভোটিং কার্যক্রম জনগণের আপত্তির মুখে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সারা বিশ্ব যখন ইভিএম পদ্ধতি লইয়া উদ্বেগ উৎকন্ঠা প্রকাশ করছে তখন সিইসি কার স্বার্থে ইভিএমের মাধ্যমে ১০০টি আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তা বোধগম্য নয়।

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কয়েক মাস আগে তোড়জোড় করে ইভিএমের জন্য আরপিও সংশোধন করাকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাদে বাকি রাজনৈতিক দল, সুধীজন, পেশাজীবী সংগঠনগুলোর অনেকে একে দুরভিসন্ধিমূলক হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সবার মতামতকে উপেক্ষা করে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত কার স্বার্থে গ্রহণ করেছেন তা জাতির সামনে উন্মোচন করা জরুরী। গত বছর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ইসির সংলাপের প্রধান বিষয় ছিল ইভিএম। ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নিয়েছিল। এর মধ্যে ২৩টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে নিজেদের মতামত দেয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ১২টি দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষকে মত দেয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সাতটি দল ইভিএমের পক্ষে মত দেয়। তবে ইসি এতদিন বলেছিল সব দল না চাইলে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু এখন কার স্বার্থে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তার কোন ব্যাখ্যা আমরা জানি না। তবে ইভিএম হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া এবং না যাওয়ার হাতিয়ার। দলীয় সরকারের অধীনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট হলে ভোট সুষ্ঠু হবে তা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এটা বলে না। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি Í যারাই ক্ষমতায় ছিল সবাই কমবেশি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিজেদের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করেছে। সে জন্য দলীয় সরকারের অধীনে এখন আর সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক হয়ে যাওয়া ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দেয়া সম্ভব নয়। নির্বাচন সুষ্ঠু করার উদ্যোগকে বাদ দিয়ে এখন শেষ সময় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ইভিএমের বিষয়টি সামনে এনে নতুন বিতর্কের সূত্রপাত করা দুঃখজনক। ইসি সূত্র জানায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য ভোটকক্ষ ধরা হয়েছে ২ লাখ বিশ হাজার। সব আসনে ইভিএম ভোট নিতে হলে ২ লাখ ৬৪ হাজার ইভিএম প্রয়োজন হবে। আর যদি ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয় তাহলে ১ লাখ ৩২ হাজার ইভিএম প্রয়োজন। কিন্তু এই অল্প সময়ে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা ইসির নেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন এর আগে ইসির সিদ্ধান্ত ছিল যেকোন একটি পৌরসভার সবগুলো কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হবে। কিন্তু বর্তমান কমিশনের অধীনে অদ্যাবধি কোন পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদেও পুরোপুরি ইভিএমে ভোট হয়নি। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশের একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান যেখানে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচিত করা যায়নি, সেখানে জাতীয় সংসদের একজন সদস্যকে কীভাবে নির্বাচিত করার চিন্তা ইসি করছে তা বোধগম্য নয়। তবে অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে ইসি ইভিএম চালুর মাধ্যমে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং পাঁয়তারা করছে।

ইভিএমে ভোট জালিয়াতি ও ভোট চুরির অফুরন্ত সুযোগ থাকবে না এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। দেশের সন্তানতুল্য জনগণ মনে করে এই মুহূর্তে ইভিএম ব্যবহার করাটা দুরভিসন্ধিমূলক। কারণ ইভিএম নিয়ে বিশ্বজুড়ে যখন হতাশা ও সমালোচনার ঝড় বইছে তখন এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন একটি কমিশন। এটা কারো অজানা নয়। তবে এই কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে যখন জনমনে প্রশ্নের উদ্বেগ দেখা দেয় তখন কারও বুঝতে বাকি থাকে না যে কমিশন হচ্ছে একটি কাগুজে বাঘ। ২০১০ সালে চট্রগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে ইভিএমের যাত্রা শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৫ জুন রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেখানকার একটি ভোট কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের সময় ইভিএম বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ওই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন। ২০১২ সালে যখন ইভিএম ব্যবহারের কথা উঠেছিল তখনও রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধিতা করেছিল। বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেয়ার পর বলেছিল ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু হঠাৎ করে কোন সুতার টানে চার হাজার কোটি টাকার ১ লাখ ইভিএম মেশিন ক্রয় করার জন্য অতিউৎসাহিত হয়েছে তা জাতির সামনে পরিষ্কার করা দরকার। তবে নির্বাচন কমিশনারদের কেউ কেউ মনে করছেন এই মুহূর্তে ইভিএমের আলোচনা সামনে আনা বা বিপুলসংখ্যক ইভিএম ক্রয় করা অনাবশ্যক। এতে বিতর্ক বাড়বে। কারণ ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দ্বিমত যেমন আছে তেমনি এটা ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষিত জনবলও নির্বাচন কমিশনের নেই।

বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে ইভিএম দিয়ে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেয়া যেমন সম্ভব তেমনি এক টিপে ৫০টি ভোট দেয়া সম্ভব। এমনকি বিদেশের মাটিতে বসেও ইভিএম হ্যাকিং করা যায় এবং একটি ইভিএম হ্যাকিং করতে এক মিনিটের বেশি সময় লাগে না। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ছোট পরিসরের নির্বাচনে ইভিএম যৌক্তিক হতে পারে, কিন্তু সংসদ নির্বাচনের মতো ক্ষমতা বদলের নির্বাচনে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা নির্বাচন কমিশন এখনো অর্জন করতে পারেনি। ভারতের কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ভরদ্বাজের ভাষ্যমতে, একটি গোপন কোড জানা থাকলেই ই-ভোটিং মেশিনের গণনাপদ্ধতি সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়া সম্ভব। মেশিনের মাদারবোর্ড তখন সেই অনুযায়ীই কাজ করবে। মেশিন আগে হাতে পেলে এই কাজ করা অনেকটাই সহজ। এমনকি মেশিন আগে হাতে না পেলেও ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে মাত্র ৯০ সেকেন্ডে এই কাজ করা যায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের কলংকের দাগ দূর করার প্রয়াসে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দেয়া এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসি নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু সে সিদ্ধান্তের ফলে দেশ যদি আবারও সংঘাতের দিকে চলে যায় তাহলে তার পুরো দায়ভার ইসিকে নিতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার চেয়ে একটি অবাধ সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা জরুরী। দেশের স্বার্থে ইসি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করবে এমটিই দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশা।

http://www.dailysangram.com/post/343891