১৯৭১ সালে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞের পর বাঙালিদের লাশ উদ্ধারের অতি পরিচিত ছবি এটি। অথচ মিয়ানমার বলেছে, এটি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের হাতে নিহত বৌদ্ধদের ছবি
১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১০:১৭

মিয়ানমারের নির্লজ্জ মিথ্যাচার

বুড়িগঙ্গা নদীর স্রোতে ভেসে এসেছে কয়েকটি লাশ। লুঙ্গি পরা একজন কৃষক লম্বা নিড়ানি দিয়ে লাশগুলো তীরে তোলার চেষ্টা করছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের নৃশংসতার ছবিটি তুলেছিলেন আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ই-আর্কাইভেও রয়েছে। এই ছবিকে মিয়ানমারে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের নৃশংসতার ছবি হিসেবে প্রচারে নেমেছে দেশটির সামরিক বাহিনী। রুয়ান্ডার শরণার্থীদের তাঞ্জানিয়ামুখী ঢলকেও ব্রিটিশ উপনিবেশকালে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার যাত্রা হিসেবে প্রচার করছে মিয়ানমার। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ছবিতে মিথ্যাচার করেও তারা বলছে, এ হচ্ছে ‘আসল সত্য’। ১১৭ পৃষ্ঠার এই প্রপাগান্ডা গ্রন্থটি এখন ইয়াঙ্গুনে বইয়ের দোকানে বিক্রি হচ্ছে। প্রকাশনায় দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করছে মিয়ানমার বাহিনী।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জনসংযোগ ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিভাগ প্রকাশ করেছে গ্রন্থটি। তারা ছবিগুলোকে প্রামাণ্য দলিল হিসেবেও দাবি করছে। তবে রয়টার্স অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছে, প্রামাণ্য দলিল হিসেবে প্রকাশিত আটটি ছবির তিনটি নিয়েই তারা জালিয়াতি করেছে।

যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ভুয়া ছবি ব্যবহার করে রোহিঙ্গা সংকটের ইতিহাস নতুন করে লেখার চেষ্টা করছে। মিয়ানমার বাহিনীর প্রপাগান্ডা ইউনিট প্রকাশিত ছবিগুলোকে রাখাইন রাজ্যের বলে দাবি করা হলেও সেগুলো আসলে বাংলাদেশ ও তাঞ্জানিয়ার। ওই প্রকাশনার মাধ্যমে মিয়ানমার বাহিনী রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞকে যৌক্তিক প্রমাণের চেষ্টা করেছে। জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধানী দল ইতিমধ্যে মিয়ানমার বাহিনীর রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসমান লাশের ঐতিহাসিক ছবিটি সম্পর্কে মিয়ানমার বাহিনীর প্রকাশনায় বলা হয়েছে, এটি ১৯৪০-এর দশকে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের হত্যাযজ্ঞের ছবি।
আরেকটি ছবিতে এক দল লোকের পদযাত্রার ছবিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বলছে, ব্রিটিশ উপনিবেশের পর ‘বেঙ্গলি’রা (রোহিঙ্গা বোঝাতে) মিয়ানমারের নিম্নাংশে (রাখাইন রাজ্য বোঝাতে) অনুপ্রবেশ করে।’

রুয়ান্ডায় সহিংসতার পর ১৯৯৬ সালে হুতু শরণার্থীদের দেশত্যাগের ছবি এটি। অথচ মিয়ানমার বলেছে, এটি ব্রিটিশ আমলে বাঙালিদের মিয়ানমারে প্রবেশের ছবি
১৯৪৮ সালে মিয়ানমারে উপনিবেশ শেষে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বোঝাতে ওই ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে রয়টার্সের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এটি ১৯৯৬ সালে রুয়ান্ডা গণহত্যা থেকে বাঁচার জন্য পালানো লোকদের ছবি। ১৯৯৬ সালে মার্থা রিয়াল নামে এক আলোকচিত্রী পিটার্সবার্গ পোস্ট গেজেটের জন্য ওই ছবিটি তুলেছিলেন। তাঁর সেই রঙিন ছবিকে সাদা-কালোতে রূপ দিয়েছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে অনুপ্রবেশের ছবি বলে দাবি করেছে দেশটির সেনাবাহিনী।

২০১৫ সালে মিয়ানমারে নৌবাহিনীর জব্দ করা এই জলযানে দেশান্তরের চেষ্টারত রোহিঙ্গারা। অথচ মিয়ানমার বলছে, সমুদ্রপথে বাঙালিদের মিয়ানমারে অনুপ্রবেশের ছবি এটি
জালিয়াতির আরেকটি ছবি ২০১৫ সালের। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে পাচারের সময় মিয়ানমার জলসীমায় আটক হওয়া জাহাজের সেই ছবির ক্যাপশনে দাবি করেছে, এভাবেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ঢুকেছে।

মিয়ানমারের সরকারের মুখপাত্র য তে ও সামরিক মুখপাত্রের সঙ্গে রয়টার্স যোগাযোগ করতে পারেনি। অন্যদিকে মিয়ানমারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব মিয়ন্ট মং তাঁর দেশের সেনাবাহিনীর ওই প্রচারণা গ্রন্থ পড়েননি দাবি করে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/09/01/674983