৩১ আগস্ট ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৩৮

৪ বছরে গার্মেন্ট সেক্টরে নারী শ্রমিক কমেছে ৯ লাখ

৩/৪ বছর আগেও দেশের গার্মেন্ট সেক্টরে নারী শ্রমিক ছিল প্রায় ৪৪ লাখ। কিন্তু বর্তমানে কমে গেছে প্রায় ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৪ বছরে গার্মেন্ট সেক্টরে নারী শ্রমিক কমেছে ৯ লাখেরও বেশি। নারী শ্রমিক ঝরে যাওয়ার পেছনে কারণ কি? এমন প্রশ্নে পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন উত্তর।
পোশাক শিল্প মালিকরা বলছেন, নারীরা একদিকে পোশাক শিল্পের প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক যন্ত্রপাতি পরিচালনায় দক্ষতা দেখাতে পারছেন না। যতটা দক্ষতা পুরুষরা দেখাতে পারছেন। অন্যদিকে পোশাক শিল্পে দীর্ঘদিন কাজ করা নারীরা স্বাবলম্বি হয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। নিজস্ব উদ্যোগে কুটির শিল্প বা ছোট পরিসরের ব্যবসা বেঁছে নিচ্ছেন। আর ব্লাস্ট, ব্র্যাক, ক্রিশ্চিয়ান এইড, নারীপক্ষ ও এসএনভি মিলিতভাবে এক গবেষণা জরিপে বলছে, মূলত যৌনহয়রানিসহ নানামুখী সম্যস্যায় পড়ে গার্মেন্ট ছাড়ছে নারীরা।
সম্প্রতি বিআইডিএসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কয়েক বছর আগেও পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের ৮০ শতাংশই ছিল নারী, বর্তমানে যা ৬৫ শতাংশের বেশি না।
সংস্থাটির সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, পোশাক খাতে নারীর কর্মসংস্থান আগে ৮০ শতাংশ ছিল। প্রায় সব গবেষণাই এ কথা বলে। তবে তাদের কর্মসংস্থান দিনে দিনে কমে আসছে। কিন্তু এ কমার হার নিয়ে অনেক তথ্য আছে। কেউ বলছে কমে গিয়ে ৮০ শতাংশ থেকে ৫৮ শতাংশে নেমে এসেছে। কেউ বলছেন ৬২ শতাংশে, কেউবা বলছে ৬৮ শতাংশে নেমে এসেছে। তথ্য যাই হোক, কমে আসছে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
তবে এ নারী শ্রমিক যে কমে যাচ্ছে এটা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা যাবে না। এদের অনেকে শ্রেণিভিত্তিক উদ্যোক্তা হচ্ছে। যে এলাকায় যে জিনিসের উৎপাদন ভালো হয়। তারা গ্রামে ফিরে সেসব জিনিস তৈরির চেষ্টা করছে। এটা তাদের স্বাবলম্বী হতে আরো বেশি সহায়তা করছে।

কিন্তু একটা বিষয় এখানে জোর দিতে হবে, সেটা হলো পোশাক শ্রমিকদের দক্ষতা। আমাদের দেশের পোশাক শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালস (সিপিডি)’র গবেষণা বলছে, এক সময়ে যে শিল্পের কর্মীদের ৮০ ভাগই ছিল নারী, এখন তাদের অংশগ্রহণ ৬০ দশমিক ৮০ শতাংশে নেমেছে। সিপিডি দেশের ১৯৩টি তৈরি পোশাকশিল্প কারখানার দুই হাজার শ্রমিকের মধ্যে জরিপ চালিয়ে বলেছে, এ খাতে বিগত ২০১২ থেকে ২০১৬ চার বছরে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। পুরুষ নারীদের মজুরির ক্ষেত্রে এ শিল্পে গড়ে তিন শতাংশ বেতন বৈষম্য রয়েছে। পুরুষদের বেতন গড়ে সাত হাজার ২৭০ টাকা হলেও নারীদের সাত হাজার ৫৮ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চার বছরে পোশাকশিল্পে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। যা ২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ছিল ৪ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। সে হিসাবে চার বছরে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি কমেছে দশমিক ৭১ শতাংশ। তৈরি পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যাও কমেছে।
সিপিডির সন্মান্বিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পোশাক শিল্পে সামগ্রিকভাবে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড় প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এবং নারী শ্রমিকরা পিছিয়ে আছে। রানা প্লাজা ধসের পর পোশাকখাতের সামাজিকভাবে অগ্রগতি হয়েছে। ২০ শতাংশ পোশাক কারখানায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র একজন শীর্ষ নেতা বলেন, পোশাক শ্রমিকদের অনেকেই কয়েক বছর কাজ করে কিছু টাকা গুছিয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। সেখানে তারা নিজস্ব উদ্যোগে কিছু করার চেষ্টা করছে। ছোট ছোট ব্যবসায় তাদের টাকা বিনিয়োগ করছে। বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্পেও তারা আগ্রহ দেখাচ্ছে। এটা একটা ভালো দিক।
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির বলেন, আমাদের দেশের পোশাক শিল্পে আগের তুলনায় অনেক বেশি অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ঘটেছে। যেখানে ভারী ভারী যন্ত্রপাতির সন্নিবেশ হয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি পরিচালনায় নারীর তুলনায় পুরুষ বেশি দক্ষতা দেখাচ্ছে। ফলে সেই জায়গাগুলোতে নারীর কর্মসংস্থান কমছে।
আদালতের নির্দেশনা থাকার পরও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধমূলক কমিটি না থাকায় বেশির ভাগ নারী পোশাক শ্রমিক এখনো প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও নিরাপত্তাকর্মীদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয় বলে বেসরকারি এক জরিপ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুর এলাকার আটটি কারখানার ৩৮২ জন নারী পোশাক শ্রমিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এ তথ্য উঠে আসে।
এতে বলা হয়, ৮৩ শতাংশ নারী শ্রমিক জানায়, তারা কারখানার সুপারভাইজর ও ব্যবস্থাপকদের মাধ্যমে নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়। ব্লাস্ট, ব্র্যাক, ক্রিশ্চিয়ান এইড, নারীপক্ষ ও এসএনভি মিলিতভাবে এই গবেষণা জরিপ পরিচালনা করে।

জরিপে অংশ নেয়া নারী শ্রমিকরা জানায়, তারা কারখানার সুপারভাইজর ও ব্যবস্থাপকদের মাধ্যমে নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়। অশালীন ভাষায় কথা বলা, কারখানায় প্রবেশের সময় নিরাপত্তাকর্মীদের অস্বস্তিকর আচরণ, চেকিং ও পুরুষ সহকর্মীর অপ্রত্যাশিত স্পর্শ এবং মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের অনৈতিক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করার মাধ্যমে তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২ শতাংশ নারী শ্রমিক জানিয়েছে, তারা কারখানার ভেতরে অথবা বাইরে শারীরিক, মানসিক ও যৌন হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে। ৬৬ শতাংশ মনে করে, তারা কোনো বিচার পাবে না, তাই প্রতিকার চাইতেও যায় না। ৬৮ শতাংশ জানায়, তাদের কারখানায় সত্যিকারভাবে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কোনো কমিটি নেই।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘নারী নির্যাতনে নানা কৌশল যোগ হয়েছে। কারখানার মালিকদের বেশি কাজ করানোর মানসিকতা থেকে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর থেকে মালিকরা বের হয়ে এলে আমার বিশ্বাস, কোনো কারখানায় যৌন হয়রানি হবে না।
তিনি বলেন, এসব বন্ধে কারখানার ম্যানেজার, সুপারভাইজরদের সচেতনতামূলক কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা যায় কি না সেটাও ভেবে দেখার সময় এসেছে। প্ল্যান বাংলাদেশের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ হুমায়রা সুলতানা বলেন, হয়রানি থেকে প্রতিকার পেতে কল সেন্টার বা অ্যাপস ব্যবহার করা হয়।
কর্মজীবী নারী সংগঠন বলছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানায় কমর্রত নারী শ্রমিকদের প্রায় ১৩ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার। শারীরিক নির্যাতনের শিকার ২০ শতাংশ। মানসিক নির্যাতনের শিকার ৭১ শতাংশেরও বেশি। আর এই নির্যাতনকারীর ভূমিকায় শীর্ষে রয়েছেন সুপারভাইজাররা।

কর্মজীবী নারী নামের এ সংগঠনের গবেষণায় দেখা যায়, ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ নারী শ্রমিকের কোনো নিয়োগপত্র নেই। ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশে নেই সার্ভিসবুক৷ তবে ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশের হাজিরা কার্ড আছে।
শ্রম আইনের লঙ্ঘন করে ৫০ শতাংশকে ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করা হয়। আর ৫০ শতাংশ ১০ ঘণ্টারও বেশি। ওভারটাইম করা বাধ্যতামূলক এবং তা দিনে দুই ঘণ্টারও বেশি। বিশ্রামের কোনো সুযোগ পান না ৭০ শতাংশ শ্রমিক। ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ সাপ্তাহিক ছুটি পান না৷ নারী শ্রমিকদের ৮৪ দশমিক ৭ শতাংশ মৌখিক হয়রানির শিকার হন। ৭১ দশমিক ৩ শতাংশ শিকার হন মানসিক নির্যাতনের। ২০ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের কথা বলেছেন। আর যৌন নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হন ১২ দশমিক ৭ শতাংশ।
আর এই নির্যাতনের ৫২ শতাংশের জন্য তারা দায়ী করেছেন পোশাক কারখানার সুপারভাইজারদের। নির্যাতনের শিকার ৩২ শতাংশই জানেন না এর বিরুদ্ধে কোথায় অভিযোগ করতে হবে।
এ ছাড়া কর্মস্থলে ডে কেয়ার সেন্টার ও বিশ্রামের জায়গা না থাকা, রাতে কাজের সময় নিরাপত্তা সংকটের কথাও উঠে এসেছে। ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ নারী বলেছেন, তাদের রাতের পালায় কাজ করতে হয়। উঠে এসেছে নারীদের কর্মস্থলে স্বাস্থ্য ও মেটার্নিটি সেবার অপ্রতুলতার কথা।
বাংলাদেশ সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের প্রধান নাজমা আক্তার বলেন, ‘পোশাক কারখানায় যারা শ্রমিক, তাদের অধিকাংশই নারী। আর যারা সিদ্ধান্ত নেন, তারা পুরুষ। ফলে নারী শ্রমিকরা নানা ধরনের হয়রানি ও প্রতিকূল পরিবেশের মুখে পড়েন। আর নারীরা পোশাক কারখানায় নেতৃত্বের দিক দিয়ে অনেক দুর্বল। আরেকটি বিষয় হল- নারীকে পোশাক কারখানায় নারী হিসেবে নয়, সস্তাশ্রমিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর সেই বিবেচনার কারণে নারীরা নানা ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন৷ তিনি বলেন, ‘সচেতন হওয়া এবং নারী শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া ছাড়াও বৈষম্য ও নির্যাতন অবহেলা থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।’

গবেষণাকারী ‘কর্মজীবী নারী’র শিরীন আখতার বলেন, ‘আমরা গবেষণাটি করেছিলাম পোশাক কারখানায় নারীদের অবস্থা জানতে। আর তাতে আমরা যে ভয়াবহ তথ্য পেয়েছি, তাতে আমরা নিজেরাই বিস্মিত হয়েছি।’
তিনি বলেন, এটি মালিকদের মানসিকতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। তারা নারী শ্রমিকদের কম মজুরিতে নিয়োগ করেন। আর তাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করতে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়, তাদের যে কোনো উপায়ে অধিক কাজ আদায় করতে বলা হয়। ফলে নারীরা নির্যাতন, বৈষ্যম্যের শিকার হন। আর পোশাক কারখানায় কমরত নারীরা বিকল্প কোনো কাজ জানেন না। তাই নানা নির্যাতনের শিকার হলেও তা প্রকাশ করেন না।’
তিনি বলেন, ‘নারী সুপারভাইজার নিয়োগ দিলেও কাজ হবে না৷ কারণ তারা তো মালিকের আদেশ বাস্তবায়ন করবে। প্রয়োজন মালিকদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন।

http://www.dailysangram.com/post/343564